বাক্‌ ।। মারুফা মিতার কবিতা

 


স্নায়বিক

 

 

ঠিক ঠিক মধ্যদুপুরে

পাখিদের কানকথা বাড়ে

অগোছালো ছায়ার মাঝে পড়ে থাকে কিছু আমিষাশী আচরণ। 

আমাদের জমে থাকা যত ব্যক্তিগত গুমোট 

তাকে রিপভ্যান ইউংকেলের ঘুম নামে ডেকো 

(সেইসব ঘুমের ভিতর কেউ কেউ

রেইনকারনেশনের গুপ্ত মন্ত্র নিয়ে মোন পাহাড়ে হারাবে একদিন)

 

আমাদের ফিরে যাওয়ার কোনো কথা ছিল না, তবু

পরস্পরের শরীর সেলাইমেশিনে মেলে দিয়ে,

ক্ষত শুকানোর আগে আমরা ফিরে যাব

যেখানে সন্ধ্যা হলেই, দিলবাহারের তারে

রাধিকা মোহন মৈত্রের আঙুল কাঁপে, ধীর লয়ে।

 

 

 

 

 

 

 

বিকল্প বৃত্তে

 

 

বাদামের খোসা ছড়ালে

আবারও স্বল্পব্যয়ী শনিবার আসে,

তোমার ঘুমের ভিতর পুস করে দেয় আর্টিফিশিয়াল স্বপ্ন 

স্বপ্নের ঘোরে কাতরাও, কেঁদে উঠ। 

মসলাপর্ব শেষ হওয়ার আগেই

ঘুম ভেঙে যায়, তখন

আংশিক তুমি অথবা তোমার মতো কেউ

প্রিয় কুকুর নিয়ে বিকেলের পার্কে হাঁটতে যাও। 

 

এসবই যেন ম্যাজিশিয়ানের হাতে রঙিন রুমাল 

মুহূর্তেই ভেল্কিবাজির পায়রা হয়ে উড়ে যায়।  

 

মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে

জোসনা কথাটা উচ্চারণ করলেই

তোমার আঙুল থেকে রুপালী সুতোয় ভর করে কিছু নর্ম নামে। 

 যেখানে বর্ষা এলে শুধু শুধু আমরা

"ভরা বাদর মাহ ভাদর" গাই, যেমন করে

ফুটানো চায়ের পাতা একটা সন্ধ্যাকে আরও মিডিওকর করে তোলে।

 

 

 

 

দীর্ঘসূত্র

 

 

কাউনের ক্ষেতে চুপকথারা ঘুমিয়ে গেলে

পৃথিবীর শরীর ভারি হয়ে উঠে। 

দুপুর ক্রমশ আলগা হয়ে যায়

আরও বেশি মনমরা নিয়ে শুকায় আনাজের ডালা,

আমরা বসে থাকি সাধারণ আলাপে। 

 

গৌড়নাচের এ বৃষ্টিবেলা 

লিরিক পড়ে থাকে শরীরি আবর্তে, তখনও

অশোকের ঘোড়া বনবীথির নাগালের বাহিরে,

খুরের শব্দে হারিয়ে যাচ্ছে

মাগধী ভাষার উপদেশনামা। 

 

আমরা বসে থাকি বিকালের ভিতরে

বিড়ালের আলস্য ফুরিয়ে যাওয়ার আগে,

একদিন উঠে যাব, যে পথে

ডাইনির আস্তানা থেকে পালিয়ে গেছে হ্যান্সল ও গ্রেটেল। 

 

 

 

 

 

অন্ধ পর্যায়কাল

 

 

ছড়িয়ে থাকা রাত্রির পায়ে মুমূর্ষু ইবাদত

আলোর বিপরীতে দাঁড়ালে

রিলিফ ক্যাম্পের ছায়া কেবলই দীর্ঘতর হয়। 

 

আলতো পি চাপড়ে ঘুম পাড়িয়ে যায় যে পাখিবেলা

সেখানে ঈষৎ ভাসে নামাবলী, যেন 

কেউ হলুদাভ নদীতে আয়ুকাল গুটিয়ে নেয়। 

দাওয়ায় বসে মেঘের পুজো দাও

বাড়ন্ত বুকের নির্যাসে পিতামহরা ডুমুর  গাছ হয়ে জন্মাবে। 

অথচ যতটুকু উলের প্রার্থনা ছিল

তার অধিক আহত ভেড়ার শুশ্রূষা নিয়ে যে বসে থাকল,

তাকে বৃষ্টির কাতরতায় নতমুখী সন্ধ্যা মনে হয়।

 

বৃষ্টি শেষে ধবল জোসনায়

ভুলে পাওয়া কাক ডেকে উঠে

কাছাকাছি কোথাও আরও দুই, তিনজন বারান্দা উড়ে যায়। 

 

 

 

 

 

বরষা

 

সবকিছু মুছে দেয়ার পরে

গেরস্ত চাঁদ হাঁপায় জলের কিনারায়। 

 

শূন্য দীঘি

পাড়ের ঘাস এবং অঘাসে

বিসুখ হওয়ার মতন

কাঠের খড়ম থেকে মেহগনি ঘ্রাণ লেগে গেছে। 

 

ঘাটের সিঁড়িতে অগোছালো 'সূর্যসিন্ধান্ত' পড়ে আছে। 

 

আরও নেমে গেলে

ঘন্টাখানিকের জন্য চমৎকার এক জলের ভাঁজ খুলে যায়,

তখন আর্যভট্ট সমস্ত মৌনতা উগরে দেয়। 

মনে হবে 

পৃথিবীর আকাশ থেকে পুলস্ত্য পশ্চিমে সরে যাচ্ছে,

ভরা বাদলের দিন সন্নিকটে। 

 

 

 

 

 

 

 

জলের সমস্ত চমৎকার নিয়ে পড়ে আছে অন্ধ পেয়ালা

 

 

বিরজু মহারাজার ঘুঙুরের শব্দ থেমে যাওয়ার আগেই

তুমি অন্যমনস্কে জানালার পাশে দাঁড়াও

ফ্রিজ খুলো, মনে হয়

এইমাত্র বারনই নদীতে গলা ভেজালে,

কন্ঠায় জমে থাকা বুদবুদ উসকে দেয় আহ্নিকগতি

তার পরের দিনেই কিনা

তোমার আঙুল থেকে গড়িয়ে পড়ে একটা আমিষাশী ভোর 

যেখানে বাতাসের ভিতর অনেক সুপারি ফুল ঝরে,

আর কিছু সাবুর পাঁপড়ের মত চিড়চিড়ে রোদ

সমস্ত রোদের ফোটন তুমি ইচ্ছা মত ব্যবহার করিও। 

 

এমন রোদ ঝলমলে নুরানি দিনে পীড়িত কলতলা, 

বালতিতে ভিজিয়ে রাখা বাসি কাপড়ের রঙ

ছড়িয়ে পড়ে সাবানজলে। 

তোমার কামিজ থেকে দুটো সেলাই খুলে রেখেছেন

দর্জির আঙুলে আরও দুই চোখ

গজিয়ে উঠছে ধীরে।

 

 

 

 

 

 

 

হেয়ারিং এইড

 

 

আগস্টের দুপুরগুলোকে এক বিষণ্ণ সাপ পেঁচিয়ে 

 

ওয়ার্ডরোবে ভাঁজ করে রাখা পুরোনো শরীর

বাথটাবের স্মৃতি নিয়ে জেগে আছে,

যদিও এই নদীমাতৃক শহর 

পাতচাউলি ঝাড়ে পাখিদের মতোই ন্যুডিটির ইন্ধন যোগায়। 

 

দূরবর্তী মরচে পড়া কার্গো ট্রেন ফিরে আসে

চোখের ভিতর লাল বিসুখ ছড়িয়ে যাওয়ার মত করে,

ফলত অপটিক নার্ভে যে চাপ পড়ে

সেখানে এক ছায়া ছায়া দেয়ালে হিংস্র ও নিরীহ ঝুলে থাকে পাশাপাশি 

দূর থেকে দেখলে মনে হবে ভাই-ভাই।

 

আমাদের বিকেল কেবলেই নিম্নমুখী পারদস্কেল 

সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে ঝরে পড়ে মৌন ফুটেজ,

দক্ষিণের  সাঁওতাল পাড়া পেরুলেই 

কামুকতায় শুয়ে থাকা পরিত্যক্ত ফেরিঘাট

তার কাছেই সাত বছরের নিরিবিলি কাল। 

 

ততদিনে আমরা জেনে গেছি

বাতিল হওয়া জুতো পায়ের দাগ বয়ে বেড়ায়। 

 

 

 

 

 

 

জোড়া শালিকের মিথ

 

 

বিহ্বলতার সন্ধ্যা এক অস্থিতিস্থাপক বিন্দুতে মূর্ত হয়ে ওঠলে

আলোছায়ার পৃথিবী নুয়ে পড়ে

হলুদ কণার ভিতর যে সহজ পারাপার, তার নিকট

প্রাচীন দাইমা বসে থাকেন।

 

 

ঝিনুকের খোল থেকে ঝড়ে পড়া চুন জামায় লেগে যায়

আর কতটা পথ পিছনে গেলে

খাজুরাহোর দেয়ালের শীত আঙুলে উঠে আসবে?

এই অমীমাংসিত সুর খানিকটা সাংসারিক  যদিও বা,

ঘন হাওয়া দিলে

ধান ফোটার শব্দ হয় ধীরে

সিদ্ধ ধানের ঘ্রাণে গার্হস্থ্য চরিত্ররাও পালটে যায়। 

ভূর্জপত্রে রচিত হয় শিশুর চোখে ঘুমের উল্লাস

গ্রামীণ মেয়েরা পৌরানিক আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসে

গুল্ম জীবন বিনিময় করে পরস্পর,

প্রত্যেকের মুখের উপর প্রসূতি হাঁসের ছায়ারা খলবল করে নিয়ত।

 

সিলিকার দ্বিধাগ্রস্থতায় মুখগুঁজে নদী পড়ে আছে

অতিদূর তরমুজ ক্ষেতে

চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করে লাল অসুখ।

 

 

 

 

 

 

ঊন বাড়ি, তোমার গায়ে অযুত রাংচিতি

 

হাসপাতালেরও আছে কিছু ব্যক্তিগত অসুখ

এই ভেবে ক্রিসমাসের ছুটিগুলো আগলে রাখে খুব

যেন বা, সব কিছুই হাতের আঙুলে সহজ সংখ্যাতত্ত্ব।

যখন জানালায় পূবের বাতাস

পিটিআই রোডে হেটে যাই মেহগনি পাতার উপশহরে,

জুটমিলের ঘরঘর আওয়াজ

ধাক্কা দেয় ঊন বাড়ির খিলখিল দুয়ারে।

 

নিজস্ব বুননে আরও কিছু বাতাস

রূপচর্চার মিহি থিউরেম

দুপুর অবধি শান্ত বাড়ির জানালা,

মূলত, সমুদ্র বিষয়ক কর্মশালা আত্মস্থ করে।

আরও বেশি গভীরতায় লবস্টারের লাল ধারণা নিয়ে

হাত বোলালেই বুঝতে পারি

ঊন বাড়ি, তোমার গায়ে অযুত রাংচিতি।

 

 

 

 

 

 

ক্লাউনের আস্তিনে গোটানো নগরের যত মিথ

 

 

উড়ে যাওয়ার ভিতর কোন মর্মর নেই, তেমন নিঃশব্দে

 

সপ্তম দুপুরে সার্কাস ভেঙে গেল। তাবুর তলে অজস্র বেনামী বেলুন ছড়ানো ছিটানো। পড়ে আছে টিকিটের ইতঃস্তত বেলা। ছেঁড়া ত্রিপলের ফুঁটো দিয়ে ঝাঁক ঝাঁক রোদ ঢুকে পড়ছে।

ক্লাউনের মুখ থেকে সব রঙ মুছার আগেই, আমরা আনাজের সাথে ভাত মাখাতে মাখাতে দুপুরের ঘুমে ঢুকে গেছি। ঘুমের ভিতর এক চৌকস স্নাইপারের লক্ষ্যবস্তু হয়ে বসবাস করছি, দৌড়াচ্ছি।

 

 

 

 

 

 

 

দূরবর্তীর

 

বুড়াইল নদীর পাড়ে একজন অর্ধেক ভিক্ষুকের ঘোড়া বৃষ্টিতে ভিজছিল। ভেজা ঘাসের কাছাকাছি মন নামিয়ে। আকাশ তখন দুপুরের বিষয়বস্তু। আর দূরবর্তী স্কুলের কামরাগুলো টিফিন বক্সের ভিতর নিরিবিলি।

এই রকম একটা দৃশ্য নিয়ে হারিয়ে গেছে আমার নিজেস্ব দূরবীন। 

 

 

 

 

দাগ

 

 

শ্যালোমেশিন থেকে উঠে আসা ঘড়ঘড় আওয়াজে

কান পাতি কিছুটা কান্নার মতন করে,

এই সহজ স্বীকারোক্তিতে জমা হয়ে আছে

ভোরের চোখে মেরুনরঙ মাফলার।

 

বাসন্তিক ধানের নামে

বাপ-দাদার আবাদি জমিতে পুঁতে রাখা বীজকথা

আইলের পর আইল আগুর ফলনের মন্ত্র।

চাষে মনযোগী আমি নামতে থাকি ধারাপাতে

টের পাইঘোলা জলের শব্দে মাগুরের ঘাই

লাঙলের ফলায় জন্মদাগ লেগে আছে, শুকানোর আগে

অহংকারী সুড়ঙ্গ পথ পৌঁছাবে মৃত্যুফুল বরাবর।

 

 

 

 

 

 

 

ঊনব্যাঙ

 

 

শুকিয়ে যাওয়া কুয়োর নিচে

খানিক জলে, খানিক অতলে

সম্মোহিত হাফমুনের আচরণ, 

সন্ধ্যার গায়ে আলো জ্বালালে কেউ 

চামড়ায় ফোটোটক্সিসিটি বাড়ে,

বুড়ো ব্যাঙ হাঁপায় আরও বেশি। 

 

বিনাই খালে জাগ দেয়া পাটের গন্ধে

স্মৃতিবেলায় পুরোনো দিনের লাফগুলো,

রাবারের অসুখ ছিটিয়ে

আঁশটে পোশাকে বর্ষা পেরিয়ে যায়।  

 

 

 

 

লুপ্ত হরফের মাঠ

 

বাতিল ট্রেনের বগি ভর্তি কুকন

এখনও তুঁত পাতার সবুজ ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে। 

 

বিকেলের নিকট বুড়িমা ছড়িয়ে থাকেন

আঁচলের গিঁট খুলে গেলে,

আতপচালের ঘ্রাণ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন একজন না-বোধক বিড়াল। 

তখনও তোমার হাতে লেগে থাকা ভ্যানিশিং ক্রিমের ঘ্রাণ

পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় এক নির্মোহ যতিচিহ্নে।

 

এইসবই নাটায়ের ছিঁড়ে যাওয়া সুতো

উড়ে যায় কাঁচগুড়োর মাঞ্জার ধারণায়। 

 

চিনিপাতা ফুল ছড়িয়ে পড়ার আগে সন্ধ্যা নামে নির্ভার রেলব্রিজে,

বাতাসের খচখচানি জিগা বন পেরুয়

শহরের শেষ বাড়ির জানালা দুলে উঠলে

দেখ, মেরুন টেবিলক্লথে

সেলাইয়ের ফোঁড় ভাইকিং ওরিওরের নির্ঘুমতা এঁকে দিচ্ছে। 

 

 

 

 

 

 

নিদান

 

 

আচারের বৈয়ামে রাজবংশী তরুণীর সুরম্য আঙ্গুল ঢুকে যায়

নখাগ্রে শ্বাসমূল জাগবে একদিন। 

 

ক্রমশ হালকা হয়ে যাওয়া বিনাই খাল

কালো জলে বড়নখা ফুলের মুখ ভিজে যায়।

ছায়া ছায়া কাঁপনে পড়ে থাকা যত

পাখি উড়ার ফুটেজ, 

সুস্বাদুর অঙ্গীকারে মুছে ফেলেছিল তারা 

যেমন করেবর্ষার সমস্ত জবাফুলের শরীর লাল হারিয়েছিল৷ 

 

অতটা বিপদগামী নয় কারুর পা

 

তবু কমফোর্ট জোনে দাঁড়িয়ে 

মফঃস্বলি স্টেশনের বৃত্তান্ত ক্রপ করছে কেউ,

অথচ একটু হেলে

রাস্তাটা তার দেশের বাড়ি হেঁটে যায়। 

 

 

 


4 comments:

  1. সম্মোহিত।

    ReplyDelete
  2. পড়লাম। প্রতিটি কবিতায় মেধা ও আবেগের, কল্পনা ও বাস্তবের, অতীত ও বর্তমানের চমৎকার সংশ্লেষ। অনুদ্ধত অনেকটা মাপা অথচ প্রাণময় ভাষায় রচিত কবিতাগুলো উপভোগ্যতায় সচ্ছল। নীরস বুদ্ধির কচকচানি ছাড়িয়ে কবিতাগুলো সজীব সৃষ্টি হয়ে উঠেছে। এসব কবিতার অন্যতম প্রধান শক্তি নিয়ন্ত্রিত অলংকারের শিল্পসুন্দর অগ্রসর ভাষার গাঁথুনি ও সাবলীল উপস্থাপনা সুকৌশল।

    ReplyDelete
  3. এতো ভালো লেখা অনেক দিন পড়িনি ।প্রতিটি লেখা মুগ্ধ করল ।

    ReplyDelete
  4. মুগ্ধতা।

    ReplyDelete