তনিমা হাজরার কবিতা

 


 

 

(১)

ভেজাল মেশানো আমাদের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, 

 

আমরা দুধে জল মেশাই, বোধে হলাহল মেশাই, সোনায় সোহাগা মেশাই, 

সোহাগে বর্বরতা মেশাই, 

 

দায়িত্বে ঘাটতি  মেশাই, স্থায়িত্বে ছিদ্র মেশাই, চিন্তায় দুশ্চিন্তা মেশাই, 

আস্থায় অনাস্থা মেশাই, 

 

ভালবাসায় অভিনয় মেশাই, বিশ্বাসে কৌতুহল মেশাই, নিঃশ্বাসে বিষ মেশাই,

ধর্মে প্রথা মেশাই,

 

কর্মে গাফিলতি মেশাই মর্মে রবাহূত বেদনা মেশাই, ত্বকে প্রসাধন মেশাই, 

হকে হারাধন মেশাই,

 

ভক্তিতে মোক্ষকাম মেশাই, মুক্তিতে পিছুটান মেশাই,এভাবে আরও কত কী মেশাতে মেশাতে ভেজালকে কখন যেন 

আর ভেজাল বলে মনে হয় না, 

 

ভেজাল খাঁটির স্ট্যাম্প লাগিয়ে  বাজারে ছড়িয়ে পড়ে,আর তখন,খাঁটিই ক্রমশঃ কেমন যেন সন্দেহজনক হয়ে পড়ে

খাঁটি হবার অহেতুক সততায়।। 

 

(২)

এক নষ্ট যুগের মধ্য দিয়ে 

হেঁটে যাই নষ্ট রাস্তায়।।

 

অযথা কলরব খেয়ে দেয়ে

হয়ে উঠি নধর পুষ্ট কলরব।। 

 

তাও, বৃত্ত হয়ে বসে আছি 

বৃত্তাকার নীরবতায়।। 

 

আমাদের অতীত ছিল সোনালী, 

ভবিষ্যৎ কুয়াশার স্তব।। 

 

একদিন আমাদেরও গর্জন ছিল, 

আজ শুধু ব্যর্থ কোলাহল।। 

 

মিথ্যে বাসনার বশে,

আত্মার উপড়ে ফেলেছি দুচোখ।

 

আমাদের প্রতিটি মৃতদেহে 

ধুকপুক করে শুধু বাঁচবার ছল।।

 

সেই ছল ভেদ করে, হে মহাপ্রাণ, 

একবার বর্তমান জাগ্রত হোক।। 

 

(৩)

আমার শিশুদের আমি 

বলেছিলাম, মানুষের উপরে রাখিস বিশ্বাস।।মানুষের দল এসে একদিন 

কেটে দিয়ে গেল তার ডালপালা, উপড়িয়ে নিয়ে গেল সেই আবাদের চাষ।।

ওরা আর শেখাবে না নির্ঘাৎ 

ওদের শিশুকে আমার মতন ওরকম  ভুল বর্ণপরিচয়।।স্লেটের উপরে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে চকখড়ি, 

মেনে নিয়ে এতাবৎ ক্ষয়।। 

 

(৪)

সূর্যের কাছে নিয়ে উত্তাপ লগ্নি

ফুলের ভিতরে হলো মধুজন্ম, 

মৌমাছি জুড়ে বসে, করে ডাকায়েতি 

মধুদের এমনই তো ভবিতব্য।।

 

মোম দিয়ে মুড়ে রাখা মৌচাক, 

তুমি কার, প্রকৃতির নাকি মানুষের?  

চোরের ওপরেও আছে বাটপার, 

ডুবতে ডুবতে সূর্য হাসলো।। 

 

ধান জানে ধার কতো কাস্তের, 

চুপচাপ বস্তাতে বন্দী, 

থালায় সাজানো গরম জুঁইফুল, 

নুন দিয়ে মেখে নিলে স্বর্গ।। 

 

শব্দের চারপাশে বোলতা, 

চাপ চাপ রক্তেরা মাটিতে, 

সব রঙ ফিরে দেবে ফির'সে, 

ঘুমোলে চলে কি আর সূর্যের।। 

 

(৫)

যে যত্ন করে গুছিয়ে রাখে 

আব্দার অমনিবাস, তার চুমুকের গুণেই,

 

 হয়তো কোনো উষ্ণ চায়ের কাপে, পত্রমুকুল ধরে ধাপসিঁড়ি ওই দিগপ্রকৃতির সবুজ চায়ের গাছে।। 

 

তাকে বলা হয়নি কোনোদিনই, 

বুকের গাঁয়ে কোথায় যে 

তার বাড়ি, 

 

জানলা কেমন, কেমন দরজা, রেলিং।  কেমন উঠোন, কেমন শোবার ঘর,

 

আগুন লেগে মাটির কোঠা, এখন দেখায়  টেরাকোটা, 

মজবুত সে দৃঢ়।। 

 

রান্নাঘরে কেমন কড়াই, থালা, 

কি পদ মেশে কোন মশলার 

গায়ে, 

 

কুটনো কোটা বাটনা বাটার দেশে, 

কোন দিকটায় এলে দখনে 

খুশির হাওয়া , 

 

কোথায় যেন ফুটলো মাধবীলতা,

জাপ্টে ধরা চন্দ্রমাতে অবুঝ  লুকোচুরির।। 

 

কেন এতো আগুন মাখার শেষেও 

সন্ধ্যে গায়ে বেঁচে বর্তে 

থাকা,

 

 কোথায় যেন মেঘজমা কপালটি ঘন ছিল দমবন্ধের জেরে, দমক লেগে এক পশলা বৃষ্টি ঝরে  গেল।।

 

এই বৃষ্টি তুমিই কী? 

 

নাকি তুমি মাধবীলতার গাছ,

 

 নাকি তুমি হাওয়ায় আঁকা দাওয়ায় রাখা সুখ, 

 

বিছিয়ে আছো শীতলপাটির মতো, 

 

নাকি তুমি উঠোন জুড়ে চাঁদের লুকোচুরি,

 

আঁচ লেগেছে কোন সুর্মার গায়ে,  উথলে পড়ে চোখের পাতা কান্না ছলোছলো,

 

তুমিই কি সে, তুমিই কি সে,

তুমিই কি সে, 

বলো?? 

 

(৬)

আমরা কিছু প্রতীকের দাস, 

সে পাথর হোক, মূর্তি কিংবা চাদর হোক,

কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের চিহ্ন, 

যে কোনো প্রকারেই 

আমরা কিছু প্রতীকের দাস।।

 

প্রতীকের সামনে ভিড় করি,

প্রতীকের সম্মুখে অবনত করি মাথা, 

প্রতীকের গোলামী করে দিই করতালি, গাই তার জয়গাথা।।

 

আত্মবিশ্বাস থেকে নেমে এসে 

কবে যে কখন 

প্রতীকেরই প্রতিনিধি হয়ে উঠি, 

প্রতীকের হয়ে গর্জাই, 

প্রতীকের হয়ে করি কাটাকুটি।।

 

প্রতীক অনন্ত হয়ে ওঠে, 

আমরা তুচ্ছ হয়ে যাই, 

প্রতীকের সম্মুখে নিজেকে দিয়ে বলি 

আত্মহত্যার রক্তে ভাত মেখে খাই।। 

 

(৭)

আমিও কী এতটা নিরাপদ আছি 

দক্ষিণরায়, 

আমারও কী আশেপাশে নেই হেতালের জঙ্গল, 

রোজ রোজ দীর্ঘ দীর্ঘ দৌড়, 

নখের আগায় লাগা ঘাম, মাংসের কুচি, আর প্রতিদিন রক্ত সমর। 

পায়ের তলার মাটি, পিছল এবং পাঁক, 

আড়ালে লুকিয়ে থাকা কুহকের ডাক,

আমারও কী তোমার মতন উলঙ্গ হলে গায়ে দেখা যাবে ডোরাকাটা দাগ, 

কে গুনেছে আদমসুমারী, 

কে জ্বালিয়েছে বলো পিদিমের বাতি, 

আমিও তোমার মতো বিপন্ন প্রজাতি, 

হে দক্ষিণরায়, 

আমারও তোমার মতো শিকার ও ভোজনের পরে বড়ো ঘুম পায়।। 

 

(৮)

 

নিজের মাপ নেব বলে ফিতে

 হাতে বসে আছি, 

 পা থেকে মাথা, থুতনির বাসরাস্তা থেকে 

 চোখের অন্ধকার গলি,

 ধুকপুক করা সবুজে আর লালে ছাওয়া  দোল দোল মাংসের হৃদয়।।

 

 কে যেন মুখের ভেতর 

 গুয়াপান গুঁজে দিয়ে বল্ল, 

 এইবারে তুই একখন্ড কাপড় হয়ে যা।।

 

 কাঁচির অধম বরাত আমার,  

 কাটলেই আটান্ন কুচি, 

 প্রতিটি খন্ডে একটি করে কবিতা লেখা,  

 ছাড়ি ছাড়ি করি রোজ, 

 কবিতা তোকে কি ঝেড়ে ফেলা, মুছে ফেলা, এতটা সহজ??? 

 

(৯)

 

একটা যেমন তেমন টান থাকলেই ঠিক ঘরে 

ফেরা যেতো, 

গোটা একটা ভালবাসাই যে লাগবে 

এমন নয়, 

আধভাঙ্গা একটা ঝগড়া, 

রঙচটা কিছু 

অভিযোগ 

ছেঁড়া ফাটা কিছু

 অভিমান, 

অথবা 

আধপোড়া সিকিসেদ্ধ কিছু

 আক্রোশপ্রসূত 

আক্রমণ, 

যাই হোক একটা 

জেনুইন  টান থাকলেই

সেই অসহ্য যন্ত্রণায় 

জ্বলজ্বল করে জ্বলবার জন্য হলেও

ঠিক রোজ ঘরে ফেরা যেতো।। 

 

(১০)

 

আজকাল আমি নিজেকে ভীষণ ভালোবাসি,

ওরা কেউ বোঝে না সেসব কথা,

ওরা বলে আমি নাকি আজকাল ভারি উদাসী। 

 

ওরা বলে বানপ্রস্থে যাও 

বয়স তো হতে গেলো পঞ্চাশ,

আমি বলি,  কই না তো, 

বৈশাখ জৈষ্ঠ্য আষাঢ় শ্রাবণ হাজার ঝামেলা পেরিয়ে

এখন আমার চলছে দুরন্ত ফাগুনমাস।  

 

এখন আমি উষ্ণ চায়ের কাপে হাত ঘসেঘসে একা একা সেই  প্রিয়তম উষ্ণতা খুঁজি,

আয়নায় চেয়ে চেয়ে দেখি কপালের পাশে রূপালি চুলের রূপ,

আমার বুকের দিঘিপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়

সেই কিশোর ছেলেটি বুঝি,

 অপলকে সে এখন দেখে সারাদিন শুধু আমাকেই।

 কিছু কথা বলে না তো। মিটিমিটি হাসে শুধু চুপ।

 

বহুদিন ধরে ঋতুর দহন মেখে ক্লান্তির মেদ লেগেছে আমার সারা গায়। 

তোমরা কেতাবি ঢঙে যাকে 'ব্যাধি' বলে থাকো,

তারাও গ্রাস করে থাকে প্রায়শই অবশ্যম্ভাবী অবসন্নতায়।

 

তবুও এখন আমার সারাদেহ জুড়ে এক দুরন্ত ফাগুন,  

সব ঋতুশেষে এখন  আমার নিশ্চিন্ত দায়মুক্ত বসন্তকাল।

 

এখন আমি মনপ্রাণ দিয়ে নিজেকে ভীষণ ভালবাসি,

ওরা ঠিক বোঝে না এসব কথা, 

ভাবে আমি বুঝি আজকাল ভারি উদাসী।।

 

(১১)

রাইফেল নাকি স্কুলব্যাগ, ছেলেটা কোনটা তুলবে, 

জুতোর ফিতে নাকি বোমা মেয়েটা কোনটা বাঁধবে, 

ইস্কুলে চাইছে কাষ্ট সার্টিফিকেট 

দাদারা দেখাচ্ছে গরজ, 

মেয়ে মরদের দল, চাইছে না অনুদান, 

চাইছে গতর ঘামানো শ্রমের ভাত, 

প্রতিবাদ করলেই সেটা মাওবাদ, 

নায্য চাইলেই সেটা সন্ত্রাস। 

ফুরিয়ে আসছে ক্রমে বনানী, শুকিয়ে আসছে ক্রমে ঝর্ণা, 

খালি পেটে এই ধর্ণা, কতদিন আর চলবে? 

দাদারা দেখাচ্ছে বাহুবল, 

চাইছে বশ্যতা, লেজ নেড়ে সব পদলেহনই করবে। 

প্রতিবাদ করলেই সেটা মাওবাদ, 

বশ্যতা না মানলেই সেটা সন্ত্রাস। 

রাইফেল নাকি স্কুলব্যাগ মেয়েটা কোনটা তুলবে, 

জুতোর ফিতে নাকি বোমা, ছেলেটা কোনটা বাঁধবে?? 

 

(১২)

 

পদ নিয়ে কথা বলা ভারি বিপদজনক

তবু্ও বলি দুচার কথা, 

 

 বিশেষ ভাবে বিশেষ্যপদ হয়ে গেলে  গায়ে পায়ে এত এত বিশেষণ যোগ হয়ে যায় যে আশেপাশের সর্বনামেরা দেখতে অত্যন্ত খর্ব লাগে।। 

 অথচ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই একটি একটি করে বিশেষণ গজিয়ে 

 ওঠে বিশেষ্যের গায়ে।। 

 

আবার উল্টো দিকে দেখতে গেলে,  আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মতন করে এক একটি  বিশেষজ্ঞ বিশেষ্যপদ, 

যারা যে যার মতো করে  কষ্টসাধ্য ক্রিয়াপদকে 

বশ ও তুকতাক করে এগিয়েছি, 

আমাদের হাঁটু ছড়ে গেছে, 

আমরা ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি, 

হেঁটে গেছি সর্বনামদের সামনে।। 

 

 বিশেষ্য আর সর্বনামের এই সম্পর্কটা   

 বড় আত্মিক। 

একটি সর্বনাম কিভাবে একটি বিশেষ্যকে স্বীকার করবে সেই বাটখারাটা বড্ড ঘোলাটে। 

কারণ সর্বনামের ব্যালটেই 

বিশেষ্যের স্বীকৃতি।। 

 

একটি সমাপিকা ক্রিয়া ঘটাতে গিয়ে 

অনেক অসমাপিকা ক্রিয়া কখন যে 

হাত ফস্কে বেরিয়ে যায়, 

কারক বিভক্তি সেকথা বেশ জানে।। 

 

জগত আমাদের নিজস্ব তুলায় মাপে, 

আমরা নিজেদের মাপি অবচেতনে, 

আবেগের সাথে সন্ধি হয়, 

বাস্তবের সাথে সন্ধি হয়, 

সে প্রত্যয়ের গ্রাফ কখনো ঋণাত্মক, 

কখনো ধন্যাত্মক।। 

 

আসলে আমাদের  কারোই হাতে 

তেমন বেহিসাবি সময় নেই, 

তাই সমাস নিয়ে ন'মাসে ছ'মাসে একবার বসি।। 

 

জীবনটা যে একটা মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সেটা অনুধাবন করি 

বিকেল বেলায় পৌঁছে।। 

 

তবে একথা  নিপাতনে সিদ্ধ যে,

 বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে ব্যয় হতে হতে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমরা প্রত্যেকেই 

এক একটি বিশিষ্ট অব্যয় পদ।।

 

(১৩)

 

ঘুম না হলে কী আর করা যাবে, 

উঠেই পড়তে হয়, স্বাভাবিক ঘুম তো কারও অধীন নয়, বরং আমরাই ঘুমের অধীন। 

কারো কারো কাছে ঘুম একটা আশ্র‍য়, কারো কারো কাছে ঘুম একটা পলায়ন।।

 

জেগে জেগে ঘুমোনোটা যেমন ট্র‍্যাজিক

তেমনি ঘুমের ভান করে জেগে থাকাটাও

একটা নিঃশব্দ বিপ্লব ।। 

 

কত রকমের ঘুম যে কিনতে, বেচতে আসে মানুষ মাঠে ঘাটে হাটে বাজারে, 

 

সারি সারি ঘুমন্ত মানুষের এই হাঁটাচলা, 

এই হাসাহাসি, কানাকানি, খেয়োখেয়ি, দলাদলি, তেলাতেলি দেখতে দেখতে আমরা বড় হই আর বড় হতে হতে 

ছোট ছোট ঘুমের বৃত্তে ঢুকে পড়ি ।।

 

অন্যকে ঘুম পাড়িয়ে সিঁধ কাটে যারা, 

তারা সব যুক্তি করে নানাপ্রকার ঘুমের মেশিন বানাচ্ছে নব নব প্রযুক্তির।। 

 

সেই মেশিনে চড়ে বসে 

 জেগে জেগে আমরা নিজেদের ঘুমন্ত অবস্থা এক্কেবারে টের পাই না।। 

 

অথচ, 

গা ঝাড়া দিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠা, আর ঘুম আঁকড়ে ধরে পালিয়ে যাওয়ার  নিরিখেই আবহমান কাল ধরে লেখা হচ্ছে 

পৃথিবীর উত্থান পতনের যাবতীয় ইতিহাস।। 

 

(১৪)

 

ডালে যতটুকু নুন চাই, ঝোলে যতটুকু তেল চাই 

আমি ঠিক ততটাই। 

 

বুদ্ধিতে যতটুকু ধার চাই, সাবানে যতটুকু ক্ষার চাই 

আমি ঠিক ততটাই। 

 

গানে যতটুকু সুর চাই, প্রাণে যতটুকু উদ্যম চাই 

আমি ঠিক ততটাই। 

 

ভ্রমে যতটুকু সংশোধন চাই, প্রেমে যতটুকু নিবেদন চাই 

আমি ঠিক ততটাই। 

 

হিতে যতটুকু বিপরীত চাই, মাঘে যতটুকু শীত চাই 

আমি ঠিক ততটাই। 

 

বন্ধুত্বে যতটুকু দাবী চাই, মরার জন্য যতটুকু খাবি চাই 

আমি ঠিক ততটাই। 

 

গালিতে যতটুকু অপমান চাই, হত্যায় যতটুকু অপরাধ চাই 

আমি ঠিক ততটাই। 

 

ধর্ষণে যতটুকু ক্লীবত্ব চাই, কর্ষণে যতটুকু কৃষক-লাঙ্গল চাই 

আমি ঠিক ততটাই। 

 

মুখোশে যতটুকু আড়াল চাই, পাপোষে যতটুকু আপোষ চাই 

আমি ঠিক ততটাই। 

 

ধ্বংসে যতটুকু ঘৃতাহুতি চাই, মাংসে যতটুকু রক্তজাল চাই 

আমি ঠিক ততটাই। 

 

কান্ডে যতটুকু পাতা চাই, ভান্ডে যতটুকু ভবানী চাই 

আমি ঠিক ততটাই। 

 

ক্লান্তিতে যতটুকু ঘাম চাই, একটি জীবনের যতটুকু দাম চাই 

আমি ঠিক ততটাই পেতে চাই।।। ত নি মা।। 

 

(১৫)

 

আসলে ঠিক ভালবাসা নয়,

জোর খাটিয়ে অধিকারবোধ কায়েম করাও নয়,

আবেগে আবদার করতে পারা যায় 

যার কাছে, এমন একজন মানুষ খুঁজছি।

 

আবদার জানালে সবসময় যে রাখতেই 

হবে এমনও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, 

তবু যেন জানাবার মতো উন্মুক্ততা থাকে।।

 

এমন একটা কাদামাটি খুঁজছি যা পেছল নয় অথচ বড় আর্দ্র। 

এমন একটা প্রশ্রয় খুঁজছি যা শাসন করে, আবার আঁকড়েও রাখে বুকের কাছে। 

 

এতদিন শুধু তাঁবেদারি করে গেছি। প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কের ভেতর নতজানু হয়ে ছিলাম। 

দান গ্রহণ করেছি, আদেশ পালন করেছি। দিতে বাধ্য হয়েছি।।

কিন্তু দেয়া-নেয়া হয়নি। 

 

আজ একটা স্বতঃস্ফূর্ত  দেয়া-নেয়া চাই। 

 

আমি ভালবাসা চাই না রে। ভালবাসার মোড়কে জোর খাটানো কোনো ক্রীতদাস সম্পর্ক ও না। 

 

শুধু যেন হাত বাড়ালেই আমি তোকে ছুঁতে পারি, তুই আমাকে ছুঁতে পারিস। এক্কেবারে গভীর পর্যন্ত।

এক্কেবারে গভীর পর্যন্ত।।।

 

(১৬)

 

তোমার সেই কাকা কি "চাইল্ড অ্যাবিউজ"শব্দটা জানতেন অরুণাংশু, 

যিনি বাচ্চাদের দিয়ে নিজের পা টেপাতেন, মালিশ করাতেন?

কিংবা,

 আমার সেই পিসিমার ভাসুর পো

যিনি ছোট মেয়েদের ইজের খুলে দেখতেন আর হাত লাগাতেন তাদের গোপন স্থানে তাদের একটু নিরালায় পেলেই।

গোলগাল গালের বাচ্চা দেখলেই প্রচন্ড জোরে গাল টিপে দেওয়া স্বভাব ছিল আমাদের সরমা কাকীমার। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম আমি একদিন সেই আদরে। 

 

 আমাদের মফঃস্বল শহরের সেই সব পাড়াতুতো দিদিরা কি "প্রাইভেসি"শব্দটার মানে জানত,

   যারা অন্যের প্রেমপত্র ছিনিয়ে নিয়ে পড়ে

 হেসে কুটিপাটি হত, 

অথবা, 

' পাড়ার সেই অনাদিকাকু, যাঁর প্রিয়তম নেশাই ছিল ছোট ছোট বাচ্চাদের প্যান্ট টেনে খুলে দিয়ে তাদের কাঁদিয়ে  খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসা।

 

এদের কারুর কোনোদিন একফোঁটা শাস্তি হয়নি  অরুণাংশু, 

প্রতিটি বিজয়ায় আমাদের অভিভাবকদের নির্দেশে এদের আমরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছি। 

আর নাড়ু,নিমকি খেয়ে নীরব থেকেছি।। 

 

শীতকালে আমাদের বাগানের কোণে ঝরাপাতা ঝাঁটপাট দিয়ে ডাঁই করে পুড়িয়ে দিতো আমাদের কাজের মেয়ে পার্বতীদিদি। 

 

এত বছর ধরে এত পাতা পুড়ে গেল, তবু্ও আমার মনের ভেতর ডাঁই করে রাখা এসব পাতাগুলো এখনো কেন পোড়েনি অরুণাংশু, 

এখনো বুকের মধ্যে পেত্নীলাগা শীতের ঘূর্ণিহাওয়ার মতো গোলগোল গোলগোল হয়ে ঘোরে ফাল্গুনের পাগলা হাওয়ায় ।।।

 

 

(১৭)

 

ছেঁড়া তার।।।। সাদা শাড়ি সরু সবুজ পাড়।।।

হলুদ পাতা।।।। ভূগোলের  হোমওয়ার্ক খাতা।।

 

মাদার মেহগনি।।।।  তোকে বহুদিন ধরে  চিনি।।

মুখে জর্দা পান।।।। যীশুর প্রার্থনা গান।।

কল্যানী দিদিমণি।। ।। আমি রিলে রেস খেলতে  জানি।।

 

কিভাবে জীবন সঠিক বোনা যায়।।।। সোজা উল্টো,উল্টো সোজা  উল কাঁটায়।।

হিসেবে কটা ঘর।।।। কি ডিজাইন।।

 

আজ ইস্কুলে দেরীতে এসেছি।।।। তাই তো ধার্য লেট ফাইন।।

ছোট শহরের ধূলো পথ।।।। আলপনা আঁকে পা তামাটে  ভবিষ্যৎ।।।। 

 

আমি তোর ঘাটে কেন যে নৌকো  বাঁধি ।।।। বৃথা বেদনার  স্বরলিপি  কেন যে রোজ রোজ সাধি।।

সেই নাছোড়বান্দা হারমোনিয়াম।।।। আবেগের তো  চার আনা মাত্র দাম।।।

 

ঘুম নেই।। ঘুম নেই।। ঘুম নেই।। চারিদিকে ওড়ে প্রথম  লাভ লেটারের ছেঁড়া খাম।।।।

কি লেখা ছিল সেই চিঠিতে  খুলে পড়েও দেখিনি।।।। জিজ্ঞাসা করিনি তাকে একবারও কি তার নাম।।।। 

 

সে এখন কোথায় থাকে।।।। তার ভালবাসার মানুষটিকে কি সম্বোধনে ডাকে।।।।

 

সব সুর, সব গান, সব মান অভিমান, সব কান্নাস্নান।। 

চড়কের মেলায় বিক্রি হয়ে গেলে

পকেটে পড়ে থাকে ক' পয়সা মূলধন।।। 

 কি ভেবেছিলে  জীবন এমনই সহজলভ্য হবে যখন তখন।।

  তোমার  ইচ্ছেমতন????

 

(১৮)

 

প্রতিটা হাসপাতালের পাশেই বেশ কয়েকটি কচুরি মিষ্টি কিংবা চা বা সিগারেটের দোকান থাকে এবং তাদের বিক্রিবাটা কিন্তু বেশ ভালোই। 

 

শোক বা দুঃখের চেয়ে ক্ষিদে বা ঘুমের তাড়না যে অনেক বেশি সেকথা অবসন্নতারা বেশ ভালো করেই জানে।

 

অনেক সময় খাদ্যগ্রহন, চা-পান বা ধূমপানের আর এক নাম কিন্তু  ধৈর্য্য।।। 

 

চৈত্র জীর্ণ হয়ে গেলে বৈশাখেরা সস্নেহে আগলে রাখে 

আগামীকাল।।

 

সেই আগামীকালের নাম  নববর্ষ কিংবা সম্পর্কের আহ্নিকগতি যা কিছু একটা হতেই পারে।।।।

 

(১৯)

 

তুই ছাড়া আমি এক কাঠখোট্টা পদাতিক,

যার রুটিনের প্রতিটি পিরিয়ডেই যুদ্ধের ক্লাস থাকে।

 

তুই এসে একটুকরো শব্দের ঘন্টা বাজিয়ে

 যুদ্ধবিরতি ডাকিস।

 

আমি তখন এ্যান্টিসেপ্টিক লোসন দিয়ে সমস্ত যুদ্ধক্ষত মুছে শান্তির মদিরা বানাতে উঠি।

 

তারপর, দুজনে দুগ্লাস পানীয় হাতে নিয়ে একসাথে

বলে উঠি.....CHEERS..।।।।।। ত নি মা।।

 

 

(২০)

 

বানভাসি চুম্বন গভীরতা মাপছে তোর,

হারিয়ে যাচ্ছি আমি সেই আঙুরের ক্ষেতে।

 

যেখানে দোলায় দুলছে আমাদের সমাজ দর্পণ,

 ব্যাকস্ক্রীণে তৈরি হচ্ছে  ছাইচাপা ব্যারিকেড।

 

যে সব সেনানীরা ছুটে আসছে গুলিবন্দুক শানিয়ে

তাদের বলিস,

কানামাছি খেলায় আব্বুলিশ এখন। 

 

এখন  নিঃ শ্বাস নিচ্ছে ভালবাসার  রেওয়াজি টি- ব্রেক।

খেলাটা কিন্তু এখনো জারি থাকবে।

 

তুই পাত্তা দিস না এইসব পালাগানের বেখাপ্পা ধরতাই।

কারণ আকাশের এস এম এস সবার কাছে আসে না।

 

যাদের যাদের কাছে এসেছে  তারা সবাই আমার বিমানে স্বাগত।।। ।।ত নি মা। 

 

 

 

(২১)

 

আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের কাছে ঘাম একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ক্ষরণ। 

 

আমাদের ছোটবেলা মশা এবং লোডশেডিংমন্দ্রিত।আমাদের জষ্টিমাসে গায়ে ঘামাচি হতো, শীতকালে গাল ফাটতো।।

 

শিবাজল পাউডার আর পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট লোশন আমাদের কৈশোর দুরন্তপনার মারাহাবা ড্যান্স। পকেট ভর্তি মার্বেল অথবা প্রচন্ড টক কুল আমাদের কৈশোরের ডিঙি নৌকো। 

 

কুঁচি দেওয়া সুতির ফ্রকের ঘেরে শিউলি কুড়োনো  আমাদের কারো কারো ব্যাক্তিগত কৌলিন্য।। 

 

জবাকুসুম তেল আর বসন্ত মালতী লোসন আর হিমানী স্নো আমাদের উদ্ভিন্নযৌবনের হরমোণ সিক্রেশন ।।

 

নিরানব্বই টাকার ছাপাশাড়ি পরে শিকাকাই সাবানে শ্যাম্পু করা চুলের বিনুনি ঝুলিয়ে আমরা দিব্যি রাজকন্যার স্টাইলে ছবি তুলে আসতাম সাদাকালো।। 

 

ঘাম আসলে আমাদের "ভিক্টোরিয়া সিক্রেটস" এর পারফিউম। 

 

জীবনে বারবার ঘামতে ঘামতে আর ঘাম মুছতে মুছতে তাই এটাই অনুভব করেছি যে, যার ঘাম নেই,

 তার আত্মাভিমানও নেই।।

 

 

 

(২২)

 

বয়স কাকে বলে?

ত নি মা হা জ রা

 

বয়স কাকে বলে??

 

তোমার আশেপাশের সম্পর্করা বলে দেয় 

তোমার কত বয়স।

তোমার কাঁধে জমে থাকা দায়িত্বেরা বলে দেয় 

তোমার কত বয়স। স্মৃতি, বিস্মৃতি, দু:খ, আনন্দ,  রাগ বা অভিমানেরা বলে দেয় 

তোমার কত বয়স।

তোমার ক্লান্তিরা বলে দেয়

তোমার কতো বয়স।

তোমার হারিয়ে ফেলা অথবা হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া মানুষেরা বলে দেয়

 তোমার কত বয়স।

তোমার সুখ যাপন  কিংবা শোকজ্ঞাপন বলে দেয় 

তোমার কত বয়স,

তোমার অনুশাসনরা বলে দেয় 

তোমার কত বয়স।

 

তুমি মানুষের কাছে যেও না,

তুমি পাহাড়ের কাছে যাও, 

তুমি নদীর কাছে যাও,

তুমি শিশির ছুঁয়ে থাকো,

তুমি আকাশ বুকে রাখো।

 

তুমি আগুনের কাছে গিয়ে বলো 

আমাকে দগ্ধ করার আগে আরো কটা দিন ছুটি দাও,

তুমি মাটির কাছে গিয়ে বলো যে 

আমাকে আরো কিছুদিন তোমাকে স্পর্শ করে হাঁটবার অবকাশ দাও।।

 

 

 

(২৩)

 

রোদ ছড়ালি বুকের পাতায়

পড়ল ঝরে সমস্ত শোক।

পাঁচমাথা মোড় কাঁপিয়ে স্লোগান 

ভালবাসা হচ্ছে, হোক।

 

 

আমার আসতে একটু দেরি, 

তুই আগেই এসে দাঁড়িয়েছিলি,

গনগনে রোদ মাথায় করে লাল করেছিস

 মুখ আর চোখ।

পাঁচমাথা মোড় কাঁপিয়ে স্লোগান, 

ভালবাসা হচ্ছে,  হোক।

 

আকাশ থেকে চাঁদ নেমেছে 

যেন আলোয় আলো পৃত্থিলোক

পাঁচমাথা মোড় কাঁপিয়ে স্লোগান, 

ভালবাসা হচ্ছে, হোক।

 

হাত বাড়িয়ে ধরেছি হাত,

স্পর্শে দিলি সমর্পন

ঠিক বুঝেছি বুক জুড়ে তোর 

আমার জন্য দ্রাক্ষাবন।

 

এসব নিয়ে কানাঘুষোয় বাড়তি গুজব 

এসব নিয়ে কুচ্ছোকাটার তুচ্ছতাতে জ্বলে মরছে মরুক কিছু লোক 

পাঁচমাথা মোড় কাঁপিয়ে স্লোগান 

ভালবাসা হচ্ছে, হোক।

 

 

কবিতা দেয় সাক্ষীসাবুদ 

কবিতা দেয় বোড়ের চাল 

আখর লিখি অঙ্গীকারে 

শব্দে সাজাই ঢাল তরোয়াল।

 

দৃষ্টিপাতেই বিস্ফোরণ, 

দৃষ্টিপাতেই বিপর্যয় 

শুকনো গাছে পত্রমুকুল 

একটুখানি সবুজ সবুজ অবুঝ বাঁচা 

 তা বাদে আর  কিচ্ছু নয়।। 

 

এই নিয়ম ভঙ্গ, জলতরঙ্গ

বোঝে না সব ধূর্ত লোক।। 

 

পাঁচমাথা মোড় কাঁপিয়ে স্লোগান 

ভালবাসা হচ্ছে, হোক।।

ভালবাসা হচ্ছে হোক।।।

 

 

 


1 comment:

  1. খুব ভাল লাগল। অসাধারণ সব কবিতা। শুভেচ্ছা রইল 💐

    ReplyDelete