পোকায় বই কাটে।
কাগজ কাটে। আমরা সবাই জানি। কিন্তু গল্প! এ তো অসম্ভব কথা! অসম্ভব হলেও এটি
সত্যি। বিশেষজ্ঞদের কথায় কাগজপত্রের গন্ধে এক ধরনের পোকা জন্মায়। কাগজ তৈরী হয়
বাঁশ আঠা এইসবের মাধ্যমে। ফলে প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞরা জানে সেই আঠা বা
বাঁশের গন্ধেই পোকারা আসে। অনেকে বলে এই পোকার নাম কাগজ কাটা পোকা । কেউ বলে।
হয়ত অন্য কিছু। বিশেষ বিশেষ ভাষায় এই পোকার নাম ভিন্ন। পোকাও ভিন্ন। কিন্তু গল্প
কাটে কোন পোকা! সেই পোকার সঙ্গে কি কাগজ কাটার পোকার কোনও মিল অমিল আছে!
# # # #
অদ্ভুত বর্ণময়
সকাল। এই বর্ণ সকালে মানুষ হাটে বাজারে। গ্রামে শহরে। অথবা ঘরে বাইরে। বর্ণময় সকাল
বলতে সূর্য কিরণ পাহাড়ের আনাচে কানাচে। অথবা মাথায় মাথায়। যীশু আর নিনি আজ পাহাড়ের
কোলে। পাহাড় দেখার সখে। পাহাড়ের মাঝে যেইখানে সমতল সেই সমতলে গবাদি পশুদের খাওয়া
দাওয়া। কচি ঘাস। অথবা অন্য কিছু । দুজনে চিপস আলুভাজা খেতে ফেতে বর্ণময় সকাল দেখে।
সকালের রোদের আঁকিবুকি। তার ভিতরেই আবার দুজনের দ্বন্দ্ব। দূরে পাহাড়ের মাথা থেকে
একটি অতি ক্ষুদ্রকায় পোকা নামে। ধীরে। অতি ধীরে। এত ধীরে যে পোকাটিকে অদৃশ্য
লাগে। যীশু পোকাটিকে দেখতে পায় বিস্ফারিত চোখ জোড়ায়। বুনো গাছ গাছালীর
ভিতর পোকাটি এক সময় হারিয়ে যায়। এই পোকাই কি তাদের দুজনের গল্প খেতে পারে! যীশু
দেখে পোকটি ছিট ছিটে কালো। বারো জোড়া পা। কোনও শুঁড় নেই।
চিপস শেষ।
আলুভাজা শেষ । প্রেম শেষ। হোটেলের ঘরে ফিরে আবার একটি ঝগড়া। তর্ক। ঝগড়ার ভিতরেই
নিনির চোখ কান গাল লাল। এত রক্তিম বর্ণ যীশু কখনও দেখেনি। যীশু উত্তেজিত হয়ে
প্রশ্ন করে তুমি কি কখনও অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘুরতে দ্যাখো বা দেখেছ! নিনি কাচের জানলা
দিয়ে দূরের আবছা পাহাড় দেখে। জানলার কাচে ফুটে ওঠে একটি অতি ক্ষুদ্র পোকা। এত ক্ষুদ্র
যে চোখে যেন দেখাই যায় না। তবুও নিনি জানলার কাচে এসে দাঁড়ায়। পোকাটির গতিবিধি
খেয়াল করে। কানজোড়া রাগে গরম। পোকা থেকে চোখ সরিয়ে যীশুকে দেখে। যীশুর
জোড়াচোখ চোখে ভেসে ওঠে। চোখজোড়ায় কি কিছু লুকিয়ে যাওয়ার গল্প থাকে! জানলা
একদমই ফাঁকা নেই। পোকাটি কাচেই থেকে যাওয়ার কথা।
প্রতি শীতে ঘুরতে
এলেই ছোট ছোট সন্দেহ ছোট ছোট তর্ক থেকেই ঘোরাঘুরি মাটি হয়ে যায়। শরীর মন
বিষিয়ে দিতে যা নাকি তড়িৎগতিতে কাজ করে। গরম চা টেবিলে রেখেই যীশু হোটেলের ঘর
থেকে মনমরা হয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে হালকা ঠান্ডা। সবুজ প্রকৃতি দেখতে দেখতে পাহাড়ী
ঢালে হাঁটে। তারপরও গল্পটি এগোয়। দুজনের অনেক অশান্তি হয়। কথা কাটাকাটি। খাওয়া না
খাওয়া। মান অভিমান। কাচের কাপ প্লেট ভেঙে ফেলা। কাচের জানলায় অ্যাসট্রে ছোঁড়া
ইত্যাদি। কিন্তু ক্ষুদ্র পোকাটি কিভাবে ঘরে প্রবেশ করে কেউ জানে না। অন্তত যীশু
নিনির চোখে পড়ে না। পোকাটি সুযোগ বুঝে গল্পের কাছে আসে। কাগজের গন্ধ পায়।
গল্পটি কাটতে শুরু করে। ফলে গল্পের বাকি অংশটি অধরা থেকে যায়।
# # # #
গল্প কাটার
পোকারা কি সবাই একই রকম! অনেকেই বলে হ্যাঁ। আবার কেউ কেউ বলে না। অথবা পোকায়
কাটা গল্পগুলিও কি সব একই রকম! কেউ কেউ বলে হ্যাঁ। আবার অনেকে বলে না। রোহিনী
মধ্য শহরের সাতশ সাতের ফ্ল্যাটে থাকে। নাচ সুন্দরী। নাচের দৌলতে ফ্ল্যাটে ঢোকে
যখন তখন। একদিন রোহিনী বাথরুমে দেখে একটি উজ্জ্বল রঙের পোকা। পোকাটি কেমন মেরুন রঙের। পোকাটির কিন্তু কোনও শুঁড় নেই। রোহিনী বাথরুমে
গিয়ে পোকটিকে দেখে থমকে যায়। কেন থমকায় রোহিনী নিজেও জানে না। একবার ওয়াক তুলে
রোহিনী ফিরে আসে খাওয়ার ঘরের বেসিনে। তিনবার চোখে মুখে জল দেয়। তবুও ওয়াক থামে
না। রোহিনী ওয়াকের জন্য শরীরে কম্পন অনুভব করে। এই কম্পন কেন! রোহিনী খুব
সাবধানেই নাচতে যায়। তবুও কি কোথাও বিপদ ঘটে! রোহিনী জানে বিপদের কোনও সময় থাকে
না। বিপদ আসে সুবিধা মতন। কবে কখন বিপদ আসে রোহিনীর মনে পড়ে না। নাচঘরে পোশাক
পাল্টাবার সময়! কিংবা যখন মধ্য রাতে শহরের ভিতর থেকে ক্যাবে চুর হয়ে ফ্ল্যাটে আসে!
বিছানাতে মেরুন একটি পোকা। রোহিনী তীক্ষ্ম চোখে পোকাটিকে খেয়াল করে। ডান হাত
দিয়ে পোকাটিকে মেঝেতে ফেলে দেয়। মেরুন রঙের পোকাটি ধীর লয়ে চলে যায় বাথরুমে।
যেখানে রোহিনী অনেকবার ওয়াক তোলে। এই গল্পে রোহিনীর সঙ্গে পোকার কোনও সম্পর্ক
নেই। রূপকও নেই।
রাত বাড়ে। বাইরে
কোলাহল নেই বললেই চলে। রোহিনী খাওয়ার টেবিলে আসে। অল্প যেন খিদে পায়। অল্প অবাক
জল পান করে। জানলা দিয়ে ঢোকে মৃদুমন্দ হাওয়া। না গরম না ঠান্ডা। রোহিনী শরীরের
কথা ভাবতে ভাবতে খুব সামান্যই প্লেটে খাওয়ার নেয়। দুটি রুটি তরকারি। ভাবে ওয়াক
এলেও বেশি খেতে পারবে না। উজ্জ্বল পোকাটিকে দেখে টেবিলের কোণে। পোকাটি রোহিনীর
দিকে তাকিয়ে। তার প্লেটের দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে থমকে। রোহিনী ভাবে বহুবর্ণের
পোকাটি কেন তাকে লক্ষ্য করে! এই ধরনের পোকা কখনও শৈশব থেকে দেখে আসেনি! তবে কি
টেবিলে কোনও পোকা নেই! মনের ভ্রম! কিন্তু বাথরুমে আজকাল কি দেখতে পায়! এই বর্ণময়
পোকাটিকেই তো! রোহিনী বেশি খায় না। মাত্র একটি রুটি। অল্প তরকারি। বাকি খাবার
পোকাটি খায়। তার খুব ছোট ছোট দাঁতের মাধ্যমে। কুটকুট শব্দ করে। খাওয়ার সময়
বিন্দু বিন্দু জোড়া চোখে রোহিনীকে দেখে। রোহিনীর গল্পও পোকাটি কাটতে শুরু
করে। গল্পটি আর এগোয় না।
# # # #
একটি বর্ণহীন
গল্প শুরু করা যাক। যদিও প্রকৃতি এখন বর্ণময়। চেরী গাছের পাতায় লালচে হলুদ রঙ।
দেখলেই নাকি পর্যটকদের মন ভরে যায় আনন্দে। রঙিন রোদ গ্লেসিয়ারে ঝলমল করে ওঠে।
মানুষ এই রোদে নিজেকে বর্ণময় করে তোলে।
অথচ এই শহরের
উত্তরের বাড়িগুলি কেমন ঠাসা ঠাসা। ঘিঞ্জি। শেষ রোদ কে দেখে কেউ বলতে পারে না।
সমস্ত শীতকাল থাকে নিরোদ। ঠান্ডা ঠান্ডা। পাশের বাড়ির কেউ বাথরুমে থুতু ফেললেও
শব্দ ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গমেরও যেন শব্দ কানে আসে। এতই ঘন ঘন ঘরবাড়ি। বদ্রীনাথ সকালে
যায় শহরের আরও উত্তরে। যেখানে পাখিহাট বসে। এই পাখিহাট খুবই নামকরা। বিখ্যাত।
পাখিহাটে ব্যবসা হয় বিভিন্ন পাখিকূলের। কোনও পাখি নাকি ডেকে ওঠে ভোরে। কেউ বা
দুপুরে। কেউবা মধ্যরাতে। নির্জনে। পল ধরে পাখির আওয়াজ তাদের বিচিত্র বর্ণের রূপ
আকৃতি সবই এখানে বিক্রি হয়। আর সেই বিক্রিতে আসে বিভিন্ন ধরনের ক্রেতারা। যেমন আজ
আসে বদ্রীনাথ। বদ্রীপাখি কিনতে। দুটি হলুদ বদ্রী কিনে বাড়িতে হাঁটা শুরু করে।
বাইরে অল্প ঝুরো বৃষ্টি। লোকে বলে বদ্রীনাথের সঙ্গে বদ্রী
পাখির কোনও মিল নেই।
কুড়ি বছর আগে এই
পাখিহাটেই লীলাদেবীর সঙ্গে প্রথম দেখা। লীলাদেবীর বয়স তখন আঠারো। পাখিহাটে আসে
বাবার সঙ্গে। বদ্রীনাথ আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখে লীলাকে। দুটি চন্দনা কেনে। চন্দনার নাচ
দেখে লীলাদেবীর মুখের কি ভাষা! চোখে মুখে চন্দনার ছাপ। উজ্জ্বলতা। বদ্রীনাথের তখন
বয়স কম। হাতে পয়সাও নেই। পাখি কেনার মতন অর্থও নেই। কিন্তু লীলাদেবীকে দেখেই থমকে
যায়। সেই প্রথম পাখিহাটে দেখা। প্রথম দর্শনেই প্রেম। তারপর তো দুজনের প্রায়ই
ছুটির দিনে পাখিহাটে আসা। প্রেমের গভীরতা বাড়া। কত কী!
আজ বাইরে চড়া
রোদ। উত্তর শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় বড় রাস্তার ধারে খুব প্রাচীন এক তেঁতুল গাছ।
তেঁতুলের সময় হলে কত মনোরম দৃশ্যে কাচা তেঁতুল ঝোলে। হাওয়ায় গাছের ঝিরিঝিরি
পাতাদল উড়ে এসে বাড়িঘর মাত করে রাখে। আজ সেইরকমই এক মাত করার দুপুর। বদ্রীনাথ দুটি
বদ্রী নিয়ে নিজের খেয়ালে ব্যস্ত। খাঁচার ভিতর কোথায় খাওয়ার রাখা যায় সেই
চিন্তাতেই ডুবে। লীলাদেবী পিছনে দাঁড়িয়ে সুঠাম বদ্রীনাথকে লক্ষ্য করে। লক্ষ্য করে
মানুষটি কি অসম্ভব পাখি পাগল! অথচ লীলা চন্দনা কেনার পর আর কোনও পাখিহাট থেকে
পাখি কেনে না। কেননা চন্দনা জোড়া দুবছর বাদে মারা যাওয়ার পর লীলার পাখিপ্রেম শেষ
হয়। পোষা জিনিসের মৃত্যু লীলাদেবীকে অত্যন্ত মানসিক আঘাত করে। এরপরেও হাটে যায়
বদ্রীনাথের জন্য। বদ্রীনাথকে না দেখলে নাকি রাতে ঘুম আসে না।
সকাল থেকেই
দক্ষিণ দিক থেকে একটি কুলকুল বাতাস শহরে। এই বাতাসে তেঁতুল পাতা নাকি সর্বত্র
ছড়িয়ে যায়। লীলাদেবী পাখিহাট থেকে আর কোনও দিন কোনও পাখি কেনে না। এখন তো বয়স অনেক!
কিন্তু বদ্রীনাথের! বেশ বয়স। তবুও পাখিসখ কমে না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বেডরুমে
পাশে একটি হলুদ বর্ণের পোকা। পোকাটির শুঁড় আছে। চোখ নেই। নাক নেই। কান নেই।
তবুও পোকাটি স্থির। সত্যিই কি পোকাটির চোখ কান নেই! তবুও পোকাটি স্থির। সত্যিই
কি পোকাটির চোখ কান নেই! তবে কীভাবে পোকাটি লীলাদেবীর বেডরুমের পাশে আসে!
বদ্রীনাথ কিন্তু বদ্রীদ্বয়কে খাওয়াতে এখনও ব্যস্ত। হলুদ বর্ণের পোকাটি কি পাখিহাট থেকে পাখিদের সঙ্গে আসে! লীলাদেবী বুঝতে পারে
না। চোখজোড়া স্থির। পাতা পড়ে না। চোখের কালো মণি দিয়ে পোকাটিকে দর্শন করে।
বুঝতে চায় এই পোকার কী নাম। এই জাতীয় পোকা কোথায় বেশি
দেখা যায়! জঙ্গলে না পাহাড়ে না গভীর অরণ্যে! লীলাদেবী পিতৃদেবের সঙ্গে কোথাও বেশি
ভ্রমণে যায় না। মাত্র একবারই নীল ফ্রক পরে নীল সমুদ্রে যায়। সমুদ্রের নীল ঢেউ দেখে
লীলাদেবী রহস্যে আত্মহারা হয়ে পড়ে। সমুদ্রের অগণিত নীল ঢেউমালা দুই চোখে এমনভাবে
আটকে থাকে যে সেই নীল ঢেউমালা আজও দেখতে পায়। কিন্তু এইরকম হলুদ বর্ণের পোকা তো কখনও ঝলমলে বালি রাশিতে দেখে না! বরং বিচিত্র বর্ণের কাঁকড়া শামুকের খোল ইত্যাদি
চোখে ভেসে ওঠে। তাহলে এই পোকারা থাকে কোথায়! কেনই বা নিজের বেডরুমে! বদ্রীনাথ
আর লীলাদেবীর গল্প আমরা কিন্তু আর বেশি পাই না। বাকি গল্পটি বোধহয় হলুদ বর্ণের
পোকাটির পেটে। কিন্তু পোকারা কি গল্প খায়! গল্প কেটে ফেলে! হয়ত।
নতুন কনসেপ্টের গল্প। ধারণার গল্প। ভালো লাগলো।
ReplyDeleteট্রিটমেন্ট এ নতুনত্ব রয়েছে। সুখপাঠ্য।
ReplyDeleteভালো লাগলো
ReplyDeleteখুব সাধারণ ৩ টে গল্পকে খুব অসাধারণ ৩ টে পোকা কেটে নিল....এবং এই পোকারা অন্য এক পোকা অথবা গল্পের কথা মনে করিয়ে দিল, ' মেটামরফোসিস '
ReplyDeleteঅন্য স্বাদের, অন্য গন্ধের গল্প। লেখার চমকারিত্বে শেষ পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে পড়লাম।
ReplyDeleteঅসাধারণ গল্প। গল্পের ভিতরে নির্মাণ ও বিনির্মাণের মধ্য়ে দিয়ে যে জলছবি তৈরি হয়, তা লেখকের মৌলিক স্বরকেই তুলে ধরে।
ReplyDelete