বাক্‌ ।। অমিত চক্রবর্তীর ১০টি কবিতা

 

 

ডাউন মেমরি লেন

 

পলেস্তারা ওঠা বাড়িটিকে একটি

সংক্ষিপ্ত চুমু দিয়েছিল সে, দেওয়ালে, ছাদে তখন

বেস গিটার হাতে লম্বা চুল, ফিউশন সঙ্গীত,

কী রাগ এটা, স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম ছিল

যতীনকাকুর, পরস্ত্রী, পরস্ত্রী, বেড়ার ওপাশে ছিল

মায়ের কাঁকরোল গাছের মাচা। ডাউন মেমরি লেন।

ডিসটোপিয়ন সমাজ আঁকে সে,

বানানো উপন্যাসে, সম্পর্ক ভেঙে পড়ছে এখানে

পাতায় পাতায়, কৌতূহল কিন্তু জ্যাজ ক্লাবে,

ফিউশন সঙ্গীত, হোটেল ছেড়ে যাওয়ার আগে

ড্রয়ারগুলো দেখো আর একবার।

                                           স্মৃতি আসলেই

একটা সঞ্চরণ, মাটি ঢাকা কোনো

উল্লাস বা আবেদন, সাজানো উপন্যাসে তাকে

বোঝার চেষ্টা তার, অথবা না বুঝেই চাপা

আক্রোশ, একজোড়া চোখ খোঁজা

অচেতনে। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন। ভেসে চলা।

 

 

তৃতীয় শালিখ

 

সাউথ ইন্ডিয়ান বেনারসী বলে একে, ভুল প্রয়োগ,

তবু তার গায়ে লেপ্টে থাকে যেন জন্ম থেকে সঙ্গী,

আমার ডাবল হেলিক্স, সেই শাড়ী, সর্বাঙ্গে তার, মনে মনে

কথোপকথন । অ্যাটমিক ক্লক পিছিয়ে পড়েছিল আজ,

সিজিয়াম অণু তাই ঠিক করে নেয় নিজেকে

তার হাসির স্পন্দনে, পৌনঃপুনিক আঘাত, এদিকে

তৃতীয় শালিখ অদৃশ্য রান্নাঘরের চালে। এ অঞ্চলে

মেনে না নেওয়ার তীক্ষ্ণ সূচ

বিরাজ করে সর্বত্র, ক্ষতচিহ্ন মনে করিয়ে দেয়

কি ভাবে দুঃস্থ সাজতে হয়, কি ভাবে অধোগামী। 

 

 

ইউনিকর্ণ

 

দক্ষতা বনাম ভাগ্যের শিকে ছেঁড়া

এই সব কেমন গুলিয়ে ফেলি আমরা, তাই প্রথমেই হয়তো

ক্ষমা চাওয়া উচিত এখনও দাঁড়িয়ে আছি বলে,

এখনও ভাসছি শরীর নিয়ে, জমকালো নয় হয়তো,

কিন্তু চেতনার শবও তো নয়, এ এক ধরণের

পাল্টা আক্রমণ। তুমি কোথায় অতন্দ্রিলা, কথা বলবে না?

শোনো তাহলে একতরফাই, শোনো টিনএজ বিষণ্ণতা,

আমি এখনও তোমার রবাব, দুএকটা তার ঢিলে হলেও,

সেই সমস্থিতি, অনুনাদ, মোটা তারের ঝালায়

আমি চিনছি তোমায়, মাপছি তোমার শূন্যতা।

পুরো ফাঁকা নয় ওঠানামা তার, অস্থিরতায় ভরা সে শূন্য,

অথচ কেউই বাড়ে না লাফিয়ে, কেউই জানে না

ইউনিকর্ণ বানাবার কৌশল । আমি দেখেছি সবুজপত্র, সরু ডাঁটা,

সাহসী প্রথমে, অথচ বন থেকে বেরোনো হরিণ,

ভীষণ উৎপাত এখানে, হুড়মুড়িয়ে খেয়ে যায়

গৃহস্থের সবজি বাগান।

 

 

এই ঘুমন্ত মেয়েটিকে আমি কোনোদিন ভালবাসতে শিখিনি

 

অন্যমনস্ক, গালে হাত দিয়ে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াত

জ্যোতির্ময়ী, প্রথমে পিয়াল গাছ ছুঁল, শেষে মালতীলতা,

আমার ওকে একবার জাগাবার শখ হয়েছিল। ইদানীং আমি

বড় বড় চোখে দেখতে থাকি অসংগতি, মানুষজনের

ক্যাফিন প্রবৃষ্ট শ্লোক,

 

ক্যাফিন, তরল সাহস, উজ্জীবিত কর আমায়, নরম শরীরে

আঁকো জেগে থাকার জখম। গতকালমোছার

ইরেজার আমার হারিয়ে গেছে বন্ধু, মুহূর্তের সাধুমন

বর্ম খুলেছে অমনোযোগে।

                    

জ্যোতির্ময়ী আবার ঘুমের ঘোরে পথ হাঁটছে,

ঈথারীয় শরীর তার, ওকে চমকে দেওয়া

ঠিক নয়, হৃদয় তাতে ভুল বুঝবে, বরং এখানে মর্মর ভালো,

বরং এখানে আমার চোখে তো সকলি শোভন ভালো,

সে মানাবে,

কারণ

এই ঘুমন্ত মেয়েটিকে আমি কোনোদিন ভালবাসতে শিখিনি,

ঘৃণা করতেও নয়।

 

 

টানেল ভিশ্যন

 

স্বপ্নে পেনাল্টি কিক কিংবা ভুল রেফারিং

এইভাবে দিন শুরু হলেও, সে কিন্তু ওস্তাদ কারিগর,

কথায় দড়, দীর্ঘদিনের অদর্শনে আমায়

কনেবউ বলে ডাকে। অতীত ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত,

ভালবাসার চাল বাড়ন্ত, পুরোপুরি নিঃস্ব ভান্ডারে

ধরা যাক মাঝরাতে

আগুন ধরে গেল আদরের ভালবাসায়,

অবিশ্বাসী হব আমি?

                             জলের গভীরে থেকে

মাছ এখন সন্ন্যাসিনী, পুকুরের বাইরে চোখ

কিন্তু সংক্ষিপ্ত কোণে, আমি পদযাত্রা শুরু করি ফের।

কোনো কোনো দিন এই টানেল ভিশ্যন

ভাল জিনিস, ন্যাড়া জামগাছকেও বুকে জড়ালে

হারিয়ে ফেলা বন্ধু মনে হয়। এইভাবে ফের

হাঁটাসৈনিকের ডুকরে কাঁদা একবার, একটুখানি

অনাস্থা, তারপর ঘুমঘুম মিঠে স্বপ্ন, তারপর

অতিবাহনের লঙমার্চ।

 

 

একটি চুম্বনের দৃশ্য

 

একটি চুম্বনের দৃশ্য সে দেখে ফেলেছিল, দেখা মানে

রেটিনায় একটা উল্টো ছবি, সরল প্রতিবিম্ব,

দুজন মানুষ অল্পসময়ের জন্য বদ্ধ হয়েছিল

অনুরাগ অথবা হঠকারিতায়,

অথচ বোঝার পদ্ধতিটা জটিল, অনুভূতিগুলো

শরীর থেকে বাইরে আনতে হয়। অথবা

জীবনের শেষ ধাপে মৃত সাজতে হবে তাকে।

সে ক্রমশ বুঝতে শেখে, বেশি জানার ফল,

সন্ধি করে অনিবার্যের সঙ্গে, এখন তাকে শরীর

পাল্টাতে হয়, মনও। একজন রমণী,

কারো এক প্রাক্তন প্রেমিকা, একবার দশতলার ওপরে

নীল শার্সির নির্বিকার ঔদাস্যে সে একটি চুমু খাওয়া

দৃশ্য দেখে, সেইথেকে পলাতক সে, অন্যমানুষ,

নীল ববটেল স্কুইড সেজে সে এখন বালিতে লুকিয়ে,

সেই থেকে সে এখন সাক্ষীসুরক্ষায়।   

 

 

সাজানো মিথ্যে

 

প্রতিটি সাজানো মিথ্যে এখন ডুবসাঁতারে

মাছের মতন দড়, অথচ কখনো সন্ধ্যায়

বা ভোরের আগে তারা পৃষ্ঠতলে আসে,

মুখ তোলে আকাশে বা নিশ্বাস খুঁজে

মেপে নিতে পুনরায় নতুন ধারার মিথ্যে।

 

এই খানেই আমার শিল্প, তুরপুণের কারিগরি।

আমি খোপ পেতে বসে থাকি মাসের পর মাস,

রুক্ষ দাড়ি, মানসিক রোগে বা আবেশে আচ্ছন্ন।

মন শরীর হয়ে যায় এখানে, শরীর মনে ঐকতান,

যা রোমন্থন করি তাইই স্মৃতি, অথচ স্মৃতি মানে

ঘটনাগুলো নয়, তাতে আমাদের প্রলেপ।

 

এত কথা আমি বলছি তোমায় কারণ ওই জলজ

মিথ্যেগুলোর সঙ্গে তোমার দেখা হবে একদিন,

বুঝে নিতে কষ্ট হবে সেগুলো তোমার মিথ্যে

না আমার, এমনই ধূসর তাদের রূপ, এমনই কুয়াসার

স্কার্ফে ঢাকা অশরীরী অলয়।

 

 

তাই যেন হও, ঝমঝমে সুখী

 

আমার সোলমেট, আমার অভিমান, পিছু ডেকো না আর,

এই বলে

পাশ ফেরে সেই পাছাপাড় শাড়ী

পুরোনো প্রেমিকারা কোথায় যায়, বংশবিস্তার করে

আড়ালে, যেখানে স্মৃতি এক অবিকল চারণ ভূমি,

অনন্ত অথচ উচ্ছৃঙ্খল। তেমনই অসীম

আমাদের মনের ভুল। তুমি কিন্তু

পরিপুষ্ট আছ মুই রাধা, সুজলা সুফলা আছ

আবছা হওনি মোটেও স্মৃতির বর্ধিষ্ণু কলেবরে।

লুকিয়ে চুরিয়ে ফের অণিমা ভ্রমণ তোমার

তুমি কি স্ফীত ঘাস আমার দোলনা ঢাকা দিয়ে, এপ্রিলের

বৃষ্টির পর সন্ত ফসল?

                                আমি অনেক হাতড়ে দেখেছি

পাঁজিপুঁথি, ফার্মার্স অ্যালমানাক, কেন তুমি মেঘ হলে

স্ফুলিঙ্গ, চকমকি পাথরের দেশে, তাই যেন হও,

সে বলেছিল, ঝমঝমে সুখী হোয়ো আমাকে ছাড়া।

 

 

রচনাসংগ্রহে যে সব লেখা বাদ পড়ে যায়

 

হৃদয়ের বেসুরো বার্তা আবার, এতদিন আমি

নিয়মমেনে চলতাম, কলুষ নিয়ে, অপরাধবোধ,

মনে যা তোলপাড় চলছে তার আকার এবং গঠন নিয়ে

নেটওয়ার্ক, বা একটা অনর্থক বিড়বিড়, একদিকে

গুরুতর শৃঙ্খলা পিস্টন, অন্যদিকে মনখারাপ।

 

অনেক বার, বহুবছর চেষ্টা করে এখন একটা

সহাবস্থানে তারা, একটা ঐক্যমত কেমন

গড়ে উঠেছে। এদিকে শান্ত, অবিচল থাকা

কালো মেঘও কিন্তু ধেয়ে আসে ফের, বৃষ্টি থামলে

আমি বাইরে আসি।

                           নক্ষত্রে কোনো কৌতূহল

নেই আর, তারা স্থিত এবং বলিষ্ঠ, এখন যা কিছু

উত্তেজনা উল্কাপাতে, পতনেই যা কিছু দাপাদাপি,

বিদূষীদের পা হড়কানোয়। রচনাসংগ্রহে

যে সব লেখা বাদ পড়ে যায় সম্পাদকের

শ্যেনদৃষ্টিতে, সেখানেই এখন সমৃদ্ধি। 

 

 

লাল মেমসাব

 

লাল মেমসাব, আমি পোক্ত ক্যামেরাম্যান,

তুমি স্টাইল চুরি করেছ

বিষণ্ণতার আবির ছুঁয়ে, অথবা সে কি এক সিঁদুরে মেঘ,

ডরিয়েছো কিন্তু ফিনেস শেখোনি, থাকো এবার,

জড়াজড়ি গেঁথে থাকো, লেপটে বুকে আমার,

মনখারাপের খোলস ছাড়ো। অনুত্তাপ হয়ো না।

ভিজে খড় ফুঁড়ে আজ ভালোবাসা ভূমিষ্ট হবে,

নহবত বাজবে উঁচুতোলা মন্ডপে, লাল মেমসাব,

পয়লা নম্বর, চোখ বুজোও তুমি, হেঁটে যাও একা

রাস্তার দুর্ভোগ টানে, অহংকার আর অভিনয়

মিলে মশলা সেজেছে এখানে অপদস্থ

জীবনপাকের।

 

 

=================

 

অমিত চক্রবর্তীর জন্ম সোনারপুর অঞ্চলের কোদালিয়া গ্রামে। ছাত্রাবস্থায় অনেক লেখা এবং ছাপানো কলকাতার নানান পত্রপত্রিকায়। পড়াশোনার সূত্রে আমেরিকা আসা ১৯৮২। এখন ক্যানসাস স্টেট ইউনিভারসিটি তে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও প্রাক্তন কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের ডিন । প্রকাশিত কবিতার বই দুটি - "অতসীর সংদারে এক সন্ধ্যাবেলা" (রা প্রকাশন ২০২১) ও "জলকে ছুঁয়ো না এখানে" (মিসিসিপির মেঘ প্রকাশন ২০২২)। দুটি পত্রিকার সহ সম্পাদক - উত্তর আমেরিকার নিউ জার্সি অঞ্চলের পত্রিকা "অভিব্যক্তি" এবং "উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা" কবিতা পত্রিকা।

 


17 comments:

  1. চমৎকার লেখা 🙏🏻

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে - অমিত চক্রবর্তী

      Delete
    2. ব্রতী মুখোপাধ্যায়23 February 2023 at 21:02

      ভাল লাগল।

      Delete
    3. খুব খুশি হলাম শুনে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

      Delete
  2. সব কবিতাগুলোই অপূর্ব। কবিকে অভিনন্দন জানাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. মন ভরে গেলো আনন্দে। অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে - অমিত চক্রবর্তী

      Delete
  3. গভীর মনস্তাত্ত্বিক সৃজন যা অনবদ্য শব্দচয়ন এবং নিখুঁত ভাববৈচিত্র্যে এক ব্যতিক্রমী সাহিত্যকীর্তির সুদূরপ্রসারী বার্তা প্রেরণ করে‌।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী যে বলি। আমি আপ্লুত। - অমিত চক্রবর্তী

      Delete
  4. অমিতবাবুর কবিতার আমি একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত, এই কবিতাগুলোতেও অনন্য ভাবের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। অনুপম লাবণ্যময় কবিতা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী আনন্দ যে হলো। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

      Delete
  5. অসাধারণ সব কবিতা

    ReplyDelete
  6. অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে। অমিত চক্রবর্তী

    ReplyDelete
  7. অনন্য কবিতাগুলি নির্মানে ও শব্দ বিভঙ্গে । ভাল লাগল খুব ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার অসংখ্য ধন্যবাদ জানবেন।

      Delete
  8. অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে

    ReplyDelete
  9. অসাধারণ সব কবিতা। ঋদ্ধ করে।

    ReplyDelete
  10. আকস্মিকভাবে পড়ে ফেললাম লেখাগুলো। ইর্ষনীয় একগুচ্ছ। খুব তাপ দিল। কিভাবে যে ঢুকু পড়লাম আপনার ওয়ালে। চুরুই হয়তো। কিন্তু ঢুকে পড়ে বিস্ময়স্তব্ধ। হাত থেকে সিঁধকাঠি পড়ে যায়।

    ReplyDelete