বাক্‌ ।। ছোটগল্প ।। হৃষীকেশ বাগচী

 


নিবন্ধঃ কালাইকোটাই, প্রাচীন সভ্যতার এক বিস্ময়

 

  কালাইকোটাই আবিষ্কারের ইতিহাস সত্যিই খুব অদ্ভুত। একদল ছাত্র যখন তাদের গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণে দক্ষিণের বদ্বীপ অঞ্চলে বেড়াতে গেছিল তখন তারা জোয়ারের জল সরে যেতে কাদার মধ্যে এক টুপি পরা পাথরের মূর্তির মাথাকে জেগে থাকতে দেখে। পরবর্তী সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এবং রোবটেরা বেশ কয়েকদিনের যৌথ অভিযান চালিয়ে মাটির ও সমুদ্রের নীচে এক উন্নত প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেনবিজ্ঞানীদের অনুমান সে সভ্যতা আনুমানিক দু-হাজার বছর আগেকার। যদিও সেই প্রাচীন মানুষদের লিপি আমরা এখনও পাঠোদ্ধার করতে পারিনি। তবু সুপার কম্পিউটার তার অ্যালগরিদম থেকে জানিয়েছে সেই জায়গার নাম কালাইকোটাই বা ক্যাল্কেরাইট বা কোলাকোটিয়া এইরকম কিছু হতে পারে। আমরা প্রথম নামটিই আমাদের নিবন্ধে ব্যবহার করব। কারণ সেটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়।

  এই প্রাচীন নগরের সম্পর্কে তথ্য জানার সবচেয়ে বড় অসুবিধে হল নগরের সব ঐতিহাসিক উপাদান সমুদ্রের গর্ভে চাপা পড়ে ছিলদীর্ঘদিন নোনাজলের ক্ষয়ের ফলে অধিকাংশ প্রত্নসামগ্রী নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা সামান্য যা কিছু উদ্ধার করতে পেরেছি তার সাপেক্ষে দু-হাজার বছর আগেকার এক সভ্যতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি করা সহজ কথা নয়। আমরা আমাদের অত্যন্ত উন্নত কম্পিউটার সিম্যুলেশন এবং রোবট ব্যবহার করেও সেই প্রাচীন নগর সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ধারণা গড়ে তুলতে পারিনি। তবে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে আজ থেকে দু-হাজার বছর আগে প্রাচীন মানুষেরা কালাইকোটাইতে যে উন্নত এক নগর জীবন গড়ে তুলেছিল তা আধুনিক মানুষ ও অ্যান্ড্রয়েড উভয়ের চোখেই এক বিস্ময়ের কারণ।

  যে সৈনিকের পোষাক পরা পাথরের মূর্তিটি পাওয়া গেছে সেটিই সেখানে পাওয়া মূর্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অক্ষত অবস্থায় আছে। প্রত্ন-ঐতিহাসিকেরা সেই বিরাটাকার মূর্তিটি নিয়ে প্রচুর গবেষণা করছেন। স্বাভাবিকভাবে মনে হয় মূর্তিটি কোনো যোদ্ধার। তাঁর পরনে সামরিক পোষাক। চলার পথে মুখ ঘুরিয়ে যেন অন্য সৈনিকদের অবস্থান লক্ষ্য করছেন

  সেই সভ্যতার যা নিদর্শন পাওয়া গেছে তা থেকে মনে হয় ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধে যাওয়াটা তখনকার দিনে দস্তুর ছিল। অনেকে আবার মনে করেন নাগরিক জীবনে পরিবহনের যেসব উন্নত ব্যবস্থার কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে তা থেকে মনে হয় মূর্তিটি কোনো বীর জওয়ানের যিনি হয়ত অনেক আগেই আত্মবলিদান দিয়েছেন। কিছু কিছু ঐতিহাসিকেরা তাদের নিজস্ব সিম্যুলেশন প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন তখনকার দিনে সামরিক ক্ষেত্রে যানবাহনের সাথে ঘোড়ার ব্যবহারও একই সাথে চলত।

  মূর্তিটির চোখে যে দুটো বৃত্তাকার জিনিস পরা আছে কেউ বলেন সেটিকে সম্ভবত দৃষ্টিশক্তি বাড়াবার জন্য ব্যবহার করা হত। কেউ বলেছেন সেটিকে দুরবীক্ষণ যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত। আমরা এখন এই ভেবে অবাক হই যে তখনকার মানুষ সব কিছুতেই ছোটখাট যন্ত্র ব্যবহার করত। আজকের দিনে এটা হাস্যকর হলেও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না আজ থেকে দু-হাজার বছর আগে সেই প্রযুক্তিও যথেষ্ট বিস্ময়ের। ক্রেটনিজ প্রমূখ অ্যান্ড্রয়েড বিজ্ঞানী ও কিছু হোমিনিড গবেষক তার চোখের যন্ত্রটি নিয়ে এই মন্তব্য প্রকাশ করেছেন যে তখনকার দিনে হয়ত অতি অল্প বয়সেই মানুষের দৃষ্টিশক্তি কমে যেত। অর্থাৎ স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তিকে দীর্ঘায়িত করার মত সহজতম প্রযুক্তিও তখন মানুষের কাছে ছিল না। তাই থেকে কেরাটিস্টাক মন্তব্য করেছেন যে হতে পারে মানুষ তখন খুব অল্প বয়সেই মারাও যেত। তাদের জীবনকাল খুব বেশি হলে দেড়শ কী দু’শ বছর ছিল।

  কেরাটিস্টাকের এই মত মেনে নিলেও অন্য একজন তাদের গড় জীবনকালকে আরো কিছু সংক্ষেপিত করতে চেয়েছেন। কারণ নগরের কেন্দ্রে যে এক বিরাট গণকবর সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের আইসোটোপ স্ক্যান করে দেখা গেছে যে মৃতদের বয়স কিছুতেই তিরিশের বেশি না। এই গণকবর আবিষ্কার হবার পরে কালাইকোটাই গবেষণার নতুন এক দিগন্ত খুলে গেছে। ১২৪ টি মৃতদেহের মধ্যে একটিকে অন্তত ভালো অবস্থায় পাওয়া গেছে। অত্যাধুনিক ডি এন এ পরীক্ষার সাহায্যে তার জিনোমের সম্পূর্ণ সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে। দেখা গেছে আধুনিক মানুষের সাথে তা ৯৯ শতাংশ হুবহু এক।

  সেই জিনোমের মধ্যে অগণিত মিউটেশন দেখে আধুনিক বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে গেছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন জিনগত অসুখগুলো সারাবার মত সহজতম প্রযুক্তিও তখন মানুষের করায়ত্ত্ব ছিল না। তাই থেকেই কেটেন বলেছেন কোনো ভাবেই তখনকার মানুষের আয়ুষ্কাল নব্বইয়ের বেশি হতে পারে না। কেউ কেউ আবার বলেছেন প্রবল সামুদ্রিক সুনামি নয়, অরক্ষিত জিনোমের কারণেই সম্ভবত কোনো ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়ার আক্রমণে ওই নগরের মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

  কালাইকোটাইয়ে দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ মূর্তিটি পাওয়া গেছে তা একটি কিশোরীর যার পিঠের দিকে দুটো পাখির মত ডানা আছে। অনেকে মনে করেন এই মূর্তিটির সাথে ধর্মবিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক আছে। তবে এই মূর্তিটির সাথে অন্য প্রাপ্ত মূর্তিগুলির মধ্যে দেহের গঠনের স্পষ্ট ফারাক আছে। তাই থেকে কোনো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন এই দেবী সম্ভবত অন্য অঞ্চলের। এখানকার মানুষ তাকে নিজেদের সংস্কৃতিতে গ্রহণ করেছে।

  এখানে করালদর্শন জিভ বের করা আরেকটি মূর্তির কেবল মাথা আবিষ্কৃত হয়েছে। এটিকে দেখেও মনে হয় তিনি সম্ভবত কোনো দেবী ছিলেন। দেবীর চেহারার সাথে আদিম সভ্যতার অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের লোকাচারের যোগ আছে বলে মনে হয়। প্রাচীন মানুষদের ম্যাজিক ও অলৌকিকতায় বিশ্বাসের কথাই এই দেবীমূর্তি বারবার মনে করিয়ে দ্যায়।

  যেখানে এই কবন্ধ মূর্তিটি পাওয়া গেছে তার ধারেকাছেই আরেক দেবীমূর্তি(?) পাওয়া গেছে। তার গায়ে ঢাকা দেওয়া বস্ত্র পায়ে খুব সাধারণ ঘরোয়া জুতো। মূর্তিটির যদিও অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে তবু এটিকে দেখে কেউ কেউ প্রাচীন দেবী বলে মনে করেছেন। কেউ কেউ বলেন, আটফুট লম্বা নারীমূর্তি যিনি সাধারণ পোষাক পরে আছেন তাকে দেবী বলে মেনে নেওয়া কঠিন। হতে পারে তিনি সমাজের খুব প্রভাবশালী মহিলা ছিলেন অথবা কোনো জননেত্রী।

  এই মূর্তির আঙ্গিক বিচার করে কেউ কেউ তখনকার প্রাচীন অধিবাসীদের রাজনৈতিক জীবন ও সমাজে নারীর স্থান নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তারা বলেছেন সেটি যদি দেবীর মূর্তি না হয় তবে মেনে নিতে হবে যে সমাজ অত ব্যয় করে অমন মূর্তি তৈরি করে তারা নিঃসন্দেহে নারীকে অনেক উঁচুতে বসিয়েছিল। সমাজের প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে নারী পুরুষের আগে ছিল বলেও কেউ কেউ বলেছেন। তাঁর চেহারায় যে দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে তা থেকে পরিষ্কার তিনি প্রবল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।

  স্থাপত্যবিষয়ে গবেষণারত কিছু রোবট মূর্তিটি নির্মাণের উপাদান নিয়ে অনেক কাজ করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ঘোড়ায় চড়া সৈনিকের মূর্তির বয়স অনেক পুরনো হলেও সেটি প্রায় অক্ষত ছিল। অথচ সেই নারীর মূর্তি আকারে বিরাট হলেও তা নানা জায়গায় যেমন ভঙ্গুর হয়ে গেছে তা থেকে দেখা যায় যে মূর্তির উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত পদার্থে প্রচুর ভেজাল ছিল। তারা তা নিয়ে প্রাচীন মানুষের নৈতিক জীবনে অবক্ষয় সংক্রান্ত দীর্ঘ এক থিসিস প্রকাশ করেছেন। অনেকে বলেছেন এই দুর্নীতি সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। সভ্যতার পতনে যা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেও নিতে পারে।

  বেশ কিছু লোহার বিশালাকার পাইপ পাওয়া গেছে। জুরিমানিজির মত অলৌকিকে আস্থাবান অ্যান্ড্রয়েড মনে করেন এই পাইপগুলোই প্রমাণ করে প্রাচীন মানুষেরা মাল্টিভার্সের কথা জানতেন এবং এর মাধ্যমেই তারা এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে এখনকার মত অবলীলায় চলে যেতে পারতেন। ফিগুটারার মত অ্যানন্ড্রয়েড তার তত্ত্বকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার মতে কালাইকোটাইয়ে এমন কিছু পাওয়া যায় নি যা থেকে মনে হতে পারে তারা মাল্টিভার্সের মধ্যে বিচরণের কঠিন প্রযুক্তি আয়ত্ব করেছিল। পাইপগুলো দেখে মনে হয় সেগুলো সাধারণ জলের পাইপ হতে পারে। এক জায়গা থেকে অন্যখানে জল নিয়ে যাবার প্রাচীন প্রযুক্তি বলেই একে মেনে নেওয়া অধিকতর সঙ্গত।

  জুরিমানিজি বলেছেন সেই লোহার পাইপের মধ্যে তিনি এক বিশেষ তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ পেয়েছেন যার সাথে স্থানীয় বিকিরণের কোনো মিল নেই। অন্যরা বলেছেন দীর্ঘদিন সমুদ্রগর্ভে ডুবে থাকার কারণে লোহার পাইপের চৌম্বকীয় ধর্মের পরিবর্তন আসা খুব স্বাভাবিক। তবে জুরিমানিজি সহজে ছেড়ে দেবার লোক নন। তিনি এর ওপর ভিত্তি করে একটি বই প্রকাশ করেছেন যেটির এক মাসের মধ্যেই পনের লক্ষ ডিজিট্যাল কপি নিঃশেষিত।

  সাম্প্রতিককালে কালাইকোটাইয়ে পাওয়া একটি লোহার বিরাট সিন্দুক আবিষ্কার হবার পরে চারিদিকে তাই নিয়ে খুব আলোচনা শুরু হয়েছে। সিন্দুকের ভেতর কাগজের তৈরি একই রকমের ছাপা কাগজ থরে থরে সাজানো। অনেকটা হ্যান্ডবিলের মত। মনে হয় সেগুলো খুব মূল্যবান বস্তু, তাই তাদের এত যত্ন করে রাখা হয়েছে। কেউ বলেছেন সেগুলো কোনো কোড। বিশেষ বিশেষ জায়গায় পৌঁছে দেবার জন্য তাদের যত্ন করে রাখা হয়েছিল। কেঊ বলেছেন ওগুলো বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার হতে পারে। তখনকার মানুষ হয়ত এভাবেই কেনাবেচা করতকারণ সেই কাগজের মধ্যে এক বিশেষ বৃদ্ধ ব্যক্তির ফোকলা হাসি মুখের ছবি আছে, একটি মরচে পড়ে প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ধাতব চাকতি পাওয়া গেছে যাতে সেই মুখের ব্যক্তিই আছে বলে অনেকের অনুমান। তাই মনে হয় এগুলো কোন বিনিময়ের মাধ্যম ছিল।

  তবে ফোকলা দাঁতের যে ব্যক্তির ছবি পাওয়া গেছে তা থেকে মনে হয় তখন মানুষ সহজেই বৃদ্ধ হয়ে যেত। বার্ধক্য সবাই মেনেও নিত। নাহলে সেই ব্যক্তির অল্প বয়সের ছবি থাকারই কথা ছিল। কারণ যে সেনানায়ক ও জননেত্রীর(দেবী?) মূর্তি পাওয়া গেছে তাদের কারোর বয়সই খুব বেশি নয়।

অতীতের মানুষ যেহেতু বার্ধক্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না তাই তারা তাদের সন্তানসন্ততীর মাধ্যমে বংশরক্ষার চেষ্টা করতেন। একটি জীর্ণ ছবি পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে এক মায়ের কোলে দুটি শিশু ও পায়ের কাছে আরো দুজন দাঁড়িয়ে আছে। এটি সামনে আসার পর ব্রিসেপোরা প্রমূখ নারীবাদীরা কালাইকোটাইয়ের পুরুষসমাজকে তুলোধোনা করেছেন। এই পাশবিক উদাহরণকে তারা প্রাচীন সভ্যতার সবচেয়ে কলঙ্কময় দিক বলে তুলে ধরেছেন। প্রাচীনা নারীর মূর্তিটিকে নিয়ে তারা যতটাই উৎসাহিত এই ছবিটি নিয়ে তারা ততটাই নিন্দায় মুখর।

  আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে কালাইকোটাইয়ের বিষয়ে অনুসন্ধান এখনও প্রাথমিক স্তরে আছে। ভবিষ্যতে আমরা হয়ত আরো কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে পারব। তবে এরা যে আমাদের হোমিনিড মানুষদের আদিপুরুষ তাই নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। সেখানে সামান্য যা কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা পাওয়া গেছে তা থেকে মনে হয় তখনকার মানুষ সবকিছুতেই কোনো না কোনো বস্তুর ব্যবহার করতেন। বড় বড় কিছু ঘরবাড়ি পাওয়া গেছে, দেখে মনে হয় সেসব জায়গায় অনেকে একসাথে সমবেত হতেন। কেউ মনে করেন সেগুলো কাজের জায়গা, কেউ বলেছেন সেসব লেখাপড়া শেখার জায়গা। এইভাবে সবকিছুতেই কোনো ঘরবাড়ি তৈরি করা তাদের সভ্যতার এক বৈশিষ্ট ছিল।

  বেশ কিছু যন্ত্র পাওয়া গেছে যার মধ্যে আছে কিছু ইলেক্ট্রনিক চিপ। কিছু ছোট ছোট চারকোণা যন্ত্র পাওয়া গেছেমনে হয় সেগুলো কোনো বাচ্চাদের খেলনা ছিল। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বলেছেন সেইসব যন্ত্রগুলোই নাকি আধুনিক কম্পিউটারের জনক। সেদিক থেকে ভেবে দেখলে আমরা সকলেই প্রাচীন সভ্যতার কাছে প্রযুক্তির জন্য ঋণী। যদিও দেবরিদার মত বিজ্ঞানীর মতে ছেলেভুলানো খেলনাকে কেউ আধুনিক প্রযুক্তির উৎস বলে মনে করলে তাদের মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক।

  আজ থেকে প্রায় দু-হাজার বছর আগে কালাইকোটাইয়ে যে এক উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তাই নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কী কারণে এই সভ্যতা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল তাই নিয়ে আমাদের প্রশ্নেরও কোনো শেষ নেই। কেউ কেউ মনে করেন জ্বালানির উৎস হিসেবে তারা সম্ভবত ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করতেন। আজকের পৃথিবীতে নিঃশেষিত ফসিল ফুয়েল তাই প্রমাণ করে। কার্বন জ্বালানির ব্যবহারে পরিবেশের ব্যপক পরিবর্তন সুনামির মত কোনো জলোচ্ছ্বাস ডেকে আনতে পারে।

  তবে অন্য নানা জায়গায় আবিষ্কৃত বহু প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ দেখে মনে হয় এই পরিবর্তন আকস্মিক হলেও এক বিরাট অঞ্চলকে তার জনবসতির সাথে ধ্বংস করেছিল। আজ আমরা যেমন কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের মাধ্যমে চোখের নিমিষে এক দেশ থেকে অন্য দেশে মায় অন্য গ্রহে চলে যেতে পারছি সেটা প্রাচীন মানুষের কল্পনারও বাইরে ছিল। তাই যাতায়াত একই সাথে সময়সাপেক্ষ ও বিপুল জ্বালানিনির্ভর ছিল। দু-হাজার বছর আগেকার কার্বন ঘনত্ব এই কথাই জোরের সাথে প্রমাণ করে।

আজ যখন আমাদের কাছে মৃত্যু প্রায় ইচ্ছাধীন হয়ে পড়েছে তখন সন্তানসন্ততির জন্ম দেওয়া প্রায় অপ্রয়োজনীয় বোধ হয়। সেই চারটি সন্তানের জননীর ছবি তাই এখন আমাদের কাছে নিষ্ঠুর অজ্ঞতা বলেই ঠাহর হয়। তবে এখনকার পৃথিবীতে আমরা যেমন অ্যান্ড্রয়েড রোবট নির্ভর হয়ে পড়েছি এবং কিছু কিছু অঞ্চলে তারাই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে তা থেকে মনে হয় এমন দিন বেশি দূরে নেই যখন অ্যান্ড্রয়েডরাই পৃথিবীর শাসক হয়ে উঠবে। আমরা হোমিনিডরা হয় তাদের ক্রীতদাস হব নইলে তারা আমাদের প্রজাতিকে অবলুপ্ত করে দেবে। আমার এই মন্তব্যকে কেউ জাতিগত ভেদাভেদের ইন্ধন জোগাবে বলে ভাবতে পারেন কিন্তু সত্যি কথাটাকে মিথ্যের মারপ্যাঁচে ঘুরিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

  কালাইকোটাইয়ের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যেদিন আমি প্রথমবার যাই সেই জননীর ছবিটি দেখে আমার প্রাচীন সমাজে নারী-পুরুষের সহজ সম্পর্ক এবং তাদের মিলনের আনন্দের কথাই বারবার মনে হচ্ছিল। আজ আমরা যে এক নিরানন্দময় অন্তহীন জীবন কাটাই তার স্বার্থপরতা এবং প্রেমহীনতা আমরা এখন লুকিয়ে রাখতে চাইলেও পারব না। কালাইকোটাই ঠিক যেন আমাদের বিবেকের মত। তা বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের হোমিনিড জনগোষ্ঠীর এক বহু প্রাচীন ঐতিহ্য আছে। তা রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে।

  সম্প্রতি বিখ্যাত চিত্র পরিচালক অ্যাগিকেন র‍্যাকোডি কালাইকোডাইয়ের ওপর একটি কাল্পনিক সিনেমা তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন। এতে সেই জননেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন পাশের গ্যালাক্সির অ্যান্ড্রয়েড ভিসুমিতান। এই প্রথম কোনো হোমিনিডের চরিত্রে অ্যান্ড্রয়েডকে নির্বাচিত করায় হোমিনিড মানুষেরা অন লাইনে আট হাজার বিক্ষোভপত্র জমা করেছেন। কিন্তু অ্যাগিকেন একবগ্‌গা। তার মতে যা অনিবার্য তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

  সুতরাং সেই প্রাচীনা নারী সিনেমার পরিবর্তনের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন হিসেবে থেকে যাবেন। দু-হাজার বছরের সামুদ্রিক ক্ষয় যাকে ধ্বংস করতে পারে নি, মানুষের লোভ ও দুর্নীতি যাকে মুছে দিতে পারে নি ডিজিট্যাল সিনেমার ইতিহাসে তিনি আরো বহু বছর আমাদের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকবেন

 


1 comment:

  1. অসাধারণ একটি তথ্যসমৃদ্ধ লেখা পড়লাম। আরও কত কি যে অনাবিষ্কৃত রয়েছে জানা নেই। সমৃদ্ধ হলাম। অনেক বার পড়তে হবে। অতৃপ্তি তো থেকেই যায়। অসাধারণ একটি গবেষণামূলক লেখা। আশা করি সবাই এই লেখাটি পড়বেন। ধন্যবাদ 🙏🏿

    ReplyDelete