বাক্‌ ।। জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

 

বুড়ো জ্বীন

জনপদের সীমান্তে সেই গ্রামে
পাহাড়ের জানু বেয়ে গড়িয়ে আসে শীত
বনজ কাঠ জ্বলে, লাল ফুলকি ছিটকে লাগে
রুপোর মলে,
কিশোরী চরণপত্র কুঁকড়ে যায় লাজে।
 
সন্ধে নামার কালে চিরায়ত আচার বিধি
জোছনাকে অবাক করে, বিস্ময়ে জাগে বিষণ্ণ প্রেমিক
আরো একবার।
পুরুষ মুগ্ধ হয়, ক্ষুধার্থ হয়, ঘুমিয়ে পরে নিশান্তে,
স্পন্দনরত ভ্রূণ অনুভব করতে করতে মৃদু হাসে
অরণ্য-দুহিতা।
 
ঋতু না বনস্থলি, কে আদিমতর সঙ্গমভুক?
কুপি নিয়ে হাতড়ে যায় ন্যুব্জ প্রবীণ।
পথিক ভাবেআরো কেউ খুঁজছে পথ, তারই মতন।
বৃদ্ধের কুপি, তার আগুন, ইন্ধন...
সঙ্গিনীর স্মৃতি
কী ভীষণ অবাক করা প্রক্রিয়ায় হাত বদলে যায়
এক আশ্চর্য প্রদীপ হয়ে!



আপাত সান্ত্বনা পেরিয়ে

বেড়ালের তুলতুলে থাবা নিয়ে দেখেছি যে হাতে
সে হাতে তারই দেওয়া আঁচড়ের দাগ
ঘুমিয়ে থাকে এভাবেইনরম কুসুমে।
মাতালের অলস-জিহ্বা সংগীত, কাছে এসে বসে
জারজ ক্ষতগুলো দুলেদুলে নড়ে ওঠে জলে।
বিষাদসম্বল নীলনগ
ঘুরে ঘুরে পাকদণ্ডি... পুরুষ
উত্তম থেকে প্রথমে স্খলন, প্রয়োজনীয় মোহস্নান
দগদগে মেঘ থেকে মেঘের ফাটল
বিনিদ্র যাপনের কোল।

ছিঁড়ে নেব ভেবেও যার পাশ কাটিয়ে
আসতে পেরেছি
ডোমপাড়া অবধি ভাসিয়ে দিয়েছে প্রসবগন্ধ
সে ছাতিমের ফুল;
খড়ি-ফোটা লাল চেলি, খুব হাসে... আহ্লাদে লুটোপুটি খায়,
কোমরে আঁচড়দাগ,
আকস্মিক প্রতিক্রিয়া ফিরিয়ে দিয়েছে তার প্রিয় মার্জার।




কথক

হিমেল রাতে রিকশাওয়ালারা কথক হয়ে ওঠে,
রিকশাস্ট্যান্ডগুলো এক একটা স্টেশন।
একলা পাইলট ইঞ্জিন সম্বল কথক অপেক্ষা করে,
জিজ্ঞেস করে উঠে বসি।
রাত দশটার ট্রেনহালকা ঝাঁকুনি দিতে দিতে
কুয়াশা ভেদ করে চলে যায় সরু রাস্তা ধরে।
বিড়ির গন্ধ নাকে আসে,
ধোয়াঁ উড়িয়ে হুইসল দেওয়ার পর
গল্প শুরু করে কথক ঠাকুর
শহীদ বেদীর পেছনে লুকিয়ে পেটো ছুঁড়েছিল,
মুরগীগুলো ঝটপট করে উঠল খাঁচার ভেতর।





ফাঁকি

সিঁদুরের ফোঁটা কেটে মন্দির থেকে ফেরার পথে
বাঁধা ছাগল দেখলে পাপবোধ উঁকি দেয়।
উনবিংশ শতাব্দীর এক অবতারের দ্বন্দ্ব মনে পড়ে,
আর আমাদের তো ঋণ-ক্লান্ত মধ্যবিত্ততা
সান্ত্বনা, ভর্ৎসনা...
যা-ই দিই নিজেকে
সেও এক ধাপ্পাই হবে।
 
কোনো প্রকার কাঁচা মাংস আর কাটাকাটির মাঝে নেই আমি--
এমন একটা বাইপাস নির্মাণ করেছি নিজের মত।
 
আজকাল রেড মিট বাদ দিয়েছি,
কেউ খুব সাধলে না করতে পারি না যদিও।
 
ছাগল-ভেড়া দেখলে বেড়াল-কুকুরের মত পিঠে হাত বুলিয়ে দিই।
ফিরে পাই অপ্রত্যাশিত স্পর্শের আড়ষ্টতা,
যেমন আড়ষ্টতা কুমারী মেয়ের শরীর ফিরিয়ে দেয় মাঝে মাঝে।
অথবা যেমন
পিরামিডের ওপর দিকে অবস্থানরত কোনো হাত, ইয়ার্কির ছলেও
হঠাৎ ঘাড়ের কাছাকাছি নেমে এলে, হাসির মাঝেই এক কবন্ধ জন্ম নেয়।





সংবেদনশীলতা প্রসঙ্গে
 
শপথও একরকম কথার কথা, মহামান্য জীবনে হঠাৎ খেলো হয়ে যায়।
বরং স্তনযুগল আর যোনির মাঝে বিস্তৃত সুরেলা তারটির কথা ভাবুন;
সেখানে ট্রাপিজের অভ্যেস করেনিএমন মানুষ দুর্লভ।
সাদা গলবস্ত্র অনেককে দূর থেকে দুলতে দেখে কাশফুল মনে হয়,
অথচ আপনার প্রাক-উৎসব ইউটোপিয়ায় তারা কেউ আমন্ত্রিত নয়।
তাদের চোখ জ্বলছে হোমে, যজ্ঞে, চিতায়... অথবা নিছকই রাত জেগে।
রাধা, রামী কিংবা আপনার প্রিয় অভিনেত্রীর জ্যামিতির কাছে
শেয়াল কিংবা বামন হয়ে যাওয়া কোনো পাত্রীর ছবি
দেখা-মাত্র নাকচ করলে আপনার ঘুম ভালো হয়।
নিষ্কাম জ্যাঠামশায়ের দ্বিতীয় বিবাহের প্রীতিভোজ তৃপ্ত করে আপনাকে।
সোনার আংটিজনৈকের মেধাবী হাসির মতই বাঁকা;
সে আংটিতে কনডম বেঁধে ফোলাতেই একটা চড় আর দুটো ছি-ছি ফেটে যায়।
ঠিকে-ঝি কামাই করে, কারেন্ট চলে যায়, কলে জল আসে না নিয়ম মেনে।
 
এত নেতির মাঝেও কী অদ্ভুত নৈপুণ্যের সঙ্গে ভাত রান্না হয় প্রতিদিন!
রাজার মত পায়ের ওপর পা, ছেঁড়া চটিআরও একদিন পার করে শাসনকাল।
 
চটে গিয়ে জানলা বন্ধ করলেন? আমি তো সবই আপনার পেছনে...
দেওয়ালের ওই ক্যালেন্ডারকে বললাম!
জিভ বেরিয়ে এসেছে, চোখে জল... উইতে কেটে কেমন করে দিয়েছে একটা চোখ!
আপনার দেখে মায়া হয় না?

 


1 comment:

  1. অপূর্ব দৃশ্যকল্প , বিলম্বিত লয়ের গণক আর পেলব কলম কবিতার এক নতুন দিশা। অনবদ্য সব কবিতা। বারবার পড়ব।

    ReplyDelete