বাক্-ফসলের মতো জন্ম হয় আমি ও অ্যান্টি-আমি’র। নিজেকে ঘিরে এই অপব্যয়িত ঘুরে
দেখা, এরপর বহিরঙ্গে ঘূর্ণন, এই নিয়েই
কবিতার কাজ। কখনও কখনও মনে হয়, জেনবাদের Abstruseness
হলো, কবিতা।
ভেদ আছে, সংযোগ
আছে; আছে Zero Thinking — প্রকৃতই যা
না, তাই যদি কবিতা হতো, তবে ঈশ্বর এবং
কবিতায় পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যেতো না। আমি সেই খুঁজে ফেরার দিকে এক খণ্ড গোলাপযান।
(‘গোলাপ ও আফিমের প্রজ্ঞা’ কাব্যগ্রন্থের
ফ্ল্যাপের অংশ)
স্ক্যাফিজম
স্ক্যাফিজমে এই পৃথিবীর পারস্য পথ।— আমার একবিন্দু বেদনার সংহিতা খুলে বসেছি
সপ্তরাত্রিব্যাপী অমীমাংসিত মাংসল পরমায়ু নিয়ে; এখানে জীবন
ধীর অপব্যয়ে কূটশাস্ত্র যত শুনে যায় কপট ব্রাহ্মণে।
সায়ানাইড সোসাইটি
একটি করুণ ফুলের দিকে এগোচ্ছি; সন্ধ্যা নামে তার অবক্ষয়ে— আর
লুপ্ত আফিম হতে কুড়িয়ে নিয়েছি মিথ! গৃহত্যাগী মন্থনপর্ব শেষে— আকাশ নেমে আসে সমুদ্রের পরজীবী জলে।
লাল সর্পযুগল তখন ধেয়ে আসে : আর কেবল পালায়, দৈন্য এক যিশুশাবক।
ড্রসেরা সানডিউ
এই কাব্যশ্মশানের জগতে আমি আর শিব হতে পারলাম না। ওই দিকেই এগোচ্ছি
ছায়ার মতো। আমি ও আমার মৃত্যু রয়েছি একা ইলোরার মদভর্তি শরীরে। গভীরে আততায়ী
লুকিয়ে করে নেয় হুইস্কিয়স্নান। ড্রসেরা সানডিউ এখনও এখানে বসে। বিশটি বছর ধরে
একটিও কথা বলে না সে আর। শুধু দিয়ে যায় সমাচ্ছন্ন বিষ। রাধার বাক্যগুলি সংকীর্ণ
হতে হলো— আমাকে
ঘিরে ধরে— তাই আরও অন্য এক নভোজিরাফ।
‘কী চাও— পাখি ও পথিক হতে?’
হায় বুদ্ধ! আজ
তোমার সংহিতায় দেখা হলো না। তবে কে লিখেছে সাতশো কোটি সনেট প্রবঞ্চন? এ-যে ভীত রাত্রি— এ-যে নরকায়ন।
সততঃ প্রেম নগ্ন স্তোত্র রচনা করে
শায়িত বৃক্ষের স্ফীত অবস্থার মতো, অন্যান্য বিষণ্ন দিন, অন্যান্য
সামগ্রিক দৃশ্যাবলি যা কিছু আমার নিকটস্থ প্রাণ; অথবা,
হিপোক্রেট ক্রিয়াকলাপ চলে যায় অতিক্রান্ত নদীর মতো। সততঃ এই অস্থির
বৃক্ষের কামিনী বসন্ত— আমি আর পাই না, সততঃ
প্রেম,— নগ্ন স্তোত্র রচনা করে; সততঃ
আমি, মৃত্যু স্তোত্র রচনা করি।— যেমন
কুহক রচনা করে-ক্ষত-অন্যান্য সমূহ দ্বৈতকার্যের-ভাষা। সততঃ আমাকে কেউ ধীর স্থির
করে, এই প্রেম স্তোত্র থেকে।
ব্ল্যাশফেমি হৃদয়
পৃথিবীকে ছুড়ে দাও কিন্নরের পূজা-যজ্ঞে; যুদ্ধবোমায় বিকলঙ্গ আমার-এ’
ব্ল্যাশফেমি হৃদয়।
*
যুদ্ধ কখনও শান্তি দেয়নি, অশ্রুর বর্ণনা ছাড়া।
*
দুঃখ আজকাল তোমাকেও পায়— ও’-শব্দবন্ধ হৃদয়।— মায়াবৃক্ষের উদীয়মান সকাল,— আবার কখন আসবে?
*
দেবযোনির কল্পকাকাতুয়া, একটি ঘাসের জঙ্গলে তবু আমায় অনন্ত-একা করে দাও।
মরু দার্শনিক
পুস্তকবীথিকার দিকে পরিহিত জঙ্গলে : আমি আর চাঁদ, কিয়ৎক্ষণ একা, হেঁটে যাই— রুক্ষ-ভগ্ন, নীলাভ
রৌদ্রের প্রাণ নিয়ে; অভিশাপে আলোহীন হলে, গ্রহ আর মৃত্তিকার আক্ষরিক প্রেম— ক্লীষ্ট-ম্রিয়মাণ
হয়, এতোটা নিশ্চিতরূপে আশঙ্কা জেগেছে আজ। তাই সম্ভাবনাহীন এক
রাতে, ব্লাইন্ড পেপারে দেখি শব্দলোকের পাতা ঝরে কেমন
আধ্যাত্মিক রাধার নিয়মে— শুধু জাগতিক অপকাজের দেখা মেলে।
বৃক্ষ যেন ছিনিয়েছে তারা, নবযক্ষের দল।—হায় মরু! এ’যেন দ্রৌপদী ও ল্যাবিরিন্থের শাড়ি।—
*
এমন পাপলোক মুক্ত হতে, আরহান্ত পেতে হবে।— অশ্বরথ
থামাবে এবার— ভয়াতক হবার পাশাপাশি আমি ভান্ত আর ভিক্ষুও।
যুদ্ধ হতে পলাতক বীর। আমার প্রীতজন হলুদ দ্রাবিড়েরা, তেমন
ভাবায় বিশ্বাসী না। সঙ্গত কারণে, দর্শনেরা অন্তর্ধান করে
চলেছে নিয়তঃ।
চক্র
‘দৃশ্যের মাঝে যে বিস্ফোরিত আগুন, তুমি কী তাই দেখছো?’
অশ্রু আজ, শুষ্ক
ও মরণাপন্ন যুগল— যেন একটি নভোপিণ্ডিকার বৃক্ষের মতো। যদি
আমি হাসি, তবু আমি কেউ না; যদি কাঁদি,
তখনও শূন্য ওড়ে নিজেকে ঘিরে। কারো কোনো অস্তিত্ব-নিরুপম চরাচর নেই।
সত্তারা যায় অন্তর্ধ্যানে।— এমন না থাকা হয়েও, দুঃখ কেন ধায় তবে, শব্দের চক্রাকারে?
গ্রন্থভূত
গ্রন্থ ছাড়া একটি কামার্ত দিনও ব্যর্থ। একদিন অমর হওয়ার দিনে আমি
তাই নির্লিপ্ত হবো। যে কোনো গোলাপ তখন তুমি হওয়ার ছিলো। রাতের চাঁদ আর মশলা বনের
ভেতর পশুরাজ এসে দেখবে আবার তোমায়— তুমি কতোদূর গেলে বানরের রন্ধনশালায়! হীরের খনি
পেতে।
অপাঙক্তেয়
অরণ্য অবধারে নির্বাসন জ্বলে পুরোহিতহৃদয় হতে— শব্দ অনন্ত বিস্ময় কাটিয়ে,
তপ্ত মেঘ হলো অধর সমর্পিত। অন্ধকারের দৃশ্য রয় নির্জন ঘুমে। সেই
ঘুমে আমি আর পতিতার ধর্মকূপ।— কূপ হতে, বৈদিকযুগের কার প্রতিশ্রুতি যেন এখনও সাঁতরে ওঠে পৃথিবীর দিকে।
*
জীবনকে বিদীর্ণ করে— এমন দুষ্ট কাহিনি লেখক, কখনও
দেখিনি আমি। সৌভাগ্য হলো তাই। দুঃখ আর সঙ্গমের স্মৃতিকাহিনি লিখে দু’চার পঙক্তি ভরিয়ে দেয় কবিতায়।
*
ভাষাহারামীর শব্দ শুনি। তিন অক্ষরের একটি কবিতা লেখার দিকে এগোচ্ছি
আজ। তাই কেউ খাদ্যগ্রহণের কথা বলে না।
বজ্রসেগুন পাতা
বজ্রসেগুন পাতায় আমার হলো শেষ জন্ম, সন্ত হৃদয় নিয়ে শুয়ে আছি পাখির অথর্বে। কী আর
বেঁচে থাকে রুগ্ন ব্রহ্মাণ্ডের দিকে? রজঃস্বলা সংলাপে তুমি
যদিও মোহিত হও। তবে এই পাপ কেন? কেন দুঃখে হয় পোপের জন্ম?
প্রয়াতঃ হৃদয়ের সমাধি হয়েছে। মদ হলে চলবে? এই
নিয়ে সুখী থাকো। তুমি একা ছিলে নিয়তঃ, যেন এই ছিল
ব্রহ্মনিয়তি। কী হবে আর সৃষ্টি করে?...
শব্দ নয়, স্ফুলিঙ্গ
ব্যাখ্যাতীত ঘুমের ভেতর বটের পাতার দেখা মেলে— সাতশো কোটি শব্দ লেখা; বৈদিক হরফে। কে জানতো! এই যে আমার হল অন্তনিয়তি। মায়াবিভ্রম এক অক্টোপাস
আমাকে জড়িয়ে রাখে নিতান্তই অসুখে; ভূতগ্রস্ত হয়ে যেকোনো বোকা
পাখির মতো টানা চোখ মেলে তার। যতোই চলি নভোমণ্ডলের দূরে প্রেতলোকে— সমাহিত এ জীবন যেন কোনো হলুদ ঘাস হয়ে। আমাকে রেখো নাতো মায়াডমরুতে;
ব্রহ্মাণ্ডে রেখে দাও, যদি কোনো স্ফুলিঙ্গ হয়ে
যাই।...তবে...
গোলাপ ও আফিমের প্রজ্ঞা
জেন শিষ্য হয়ে পৃথিবীর মরীচিকার দিকে ঘোরা আমার অভ্যাস হয়েছে এক
মর্মাহত দিনে। এখন শুধু হর্ষস্নান বাকি। যেন-বা পাল কৌশাম্বিনী; ঝর্ণার বিড়ম্বনার মতো হাসি তার।
দেখ— যতদূর আমি যেতে চাই কেবল বংশ বিস্তার করে, মৃদু সর্পের’বাহিনী। মৃত্যুর শিল্প জানা ঐ-আগন্তুক
জ্রেবার দিকে,— প্রশ্নের বহ্নিচোখ দেই ছুড়ে— যেন-বা নিশ্চল হয়ে পড়ে না থাকে দুটি হৃদয়ের পথ। মেঘদর্পণে তুলে রাখি পিতার
ধর্মবাক্স। হলদে হয়ে যাওয়া চোখ, আর কিছু বলেনি তেমন ভাষা—
তিনি মূক হয়ে গেলেন পৃথিবীর মৃদু বাক্যের দিকে এসে, লুটিয়ে পড়েন ঘাসের শৃঙ্খলে। কে-বা চায় তাঁর মৃত ধ্বনি শুনিতে! সময় গেল যখন
আকস্মিক বিস্ময়ে, মায়ের বিন্দু জল পাপ নিয়ে আসে ভগ্ন
লালিমায়। পুরুষাঙ্গ এতোদূর এসেও থামেনি—
যখন ফড়িঙ গেল আবর্তের মতো ঘুরে। বহুবার তারা এলো, বলে গেল, ‘বিজেত্রীর ঘরে আমি যাইনি সেদিন, লোকে তবু আমাকেই
বেরুতে দেখেছে।’ অথচ ভ্রষ্ট তারা;— দেখেছে
গোলাপ ও আফিমের প্রজ্ঞা। একদিন মৃগীর বুকে শুয়ে ছিল সহস্র পরমৃগ; শিশুটি বুঝে নিল— যৌনদুঃখের ব্যাখ্যায় পৃথিবী
অচ্ছুত হয়ে যায়— জননীর বিস্মৃতি ঘাতকের ফলার মতো— কিংবা পুরুষাঙ্গস্মৃতির মতো বাহুল্য।
আধিদৈবিক দুঃখেরা
পক্ষাঘাতগ্রস্ত সমস্ত প্রাণীরা লুপ্তপ্রায় বল্মীকস্তূপের ন্যায়, মহাজাগতিক লাস্যময়তার টানে
অথর্ব আশ্চর্যে দ্রুত লুপ্ত হয়ে যাবে। — আমি আরও অবসাদ হয়ে
পড়ি, — জেনে, মৃত পাখিটির ভাষায় বহুবিধ
নির্লিপ্ততার মতো দেখি; সেই ক্লিষ্ট-হৃত এক নিভৃত মৎস্যের
বেদনায় পৃথিবী ধীরে ঘাসের অস্তিত্ব নিয়ে ক্ষীণ হয়ে যাবে।
আমার কাছে প্রীত অন্ধকারেরা নগ্ন ঈশ্বরীর ন্যায়, ঘিরে থাকে— কে জানে, আধিদৈবিক দুঃখেরা হয়তো বা সবিস্মৃত ঘাসেদের
হৃদয় থেকে ক্রমাগত নিজস্ব প্রীত তারকাদের খুঁজে নিবে। খুঁজে নিবে বিষণ্ন হৃষ্ট
কোনো প্রাণ।
সাইলেন্স রেভোল্যুশন
এতোটাও কঠিন তুমি নও। ও আর তুমি নও হে শব্দ সারৎসার। আজ আমার ভস্ম হলো চাঁদ। এই
মর্মাহত যুগে, আর নিজেকে ব্রজনিখিল ভেবো না। তুমি যে কপট
দরবেশ বনে গিয়েছ সেদিন—লোকারণ্যে খুলো না আর উপস্থ নগর।
ব্রহ্মাহত হলে তো এবার?... চক্ষুদ্রষ্টা চোখ খুলে প্রাণ নিচ্ছে ঘাসের
প্রহারে। দীর্ঘ এ প্রহার।
দাহচক্রাবূহ
দাহচক্রাবূহে তাই অতীব প্রয়োজনে দেখা হয়; আর সবকিছু হয়েছে ক্ষীণ।
অসংখ্যেয় অন্ধকার-বিদীর্ণলিপিবর্গ। ব্যর্থ গণিকা যে আজ তুমি;
প্রকৃতির তব বিধবা হৃদয়— মলিন সংলাপের দিকে
এগোও : আরও কিছু দূরে। সকল মূঢ় লোক বলে তুমি প্রবঞ্চিতা; কোনো
নক্ষত্র—গ্রহমণ্ডল নও আর তবে? এদিকে
সর্বহারা প্রেত আমার কুটিরে জপমালা গীত করে। ওই যে! একদল ন্যাংটা কালসর্পবাহিনী
এদিকে আসে তেড়ে।
চলো পালাই আজ, একটি রাবারবৃক্ষের তলে। স্ক্র্যাচ মুছে গেলে ক্ষান্ত হবে বাগাড়ম্বর।
দৈববাণীর মত চিরসত্য। অনেকদিন পর এক বিস্ময়, আবার আবিস্কারের প্রেরণায় ভাবনার জানলায় একটা ঝাঁকুনি বলা যায়।মনে আশার সঞ্চার হয় এইসব কবিতা পড়ে। আবার পড়ব। বারবার পড়ার মত। কবিকে সম্মান জানাই 💐
ReplyDelete