বাক্‌ ।। অর্ক অপুর কবিতা

 

সুন্দরবন ডায়েরি

অনেকেই আছেনকানের সাথে চোখের সম্পর্ক ভালো। হরিণ শব্দে দেখতে পানচিড়িয়াখানার বন্ধ খাঁচায় ডোরাকাটা দাগ, অথবা সুন্দরবন ভ্রমণে দেখা সবুজের ঝোপে চঞ্চল চমক। আর বাকিদের অনেকে হরিণ শব্দে দেখতে পানবাঘ ছুটছে অথবা কোনো একবারের ভ্রমণে খাওয়া মাংসের স্বাদ। এক প্রেমিক অথবা জাদুকর কবিকে জানি, যিনিহরিণ শব্দে 'কস্তুরি কস্তুরি' চিৎকারে জপেনসুগন্ধী ঘরের চামড়ার চাকচিক্য...

আমারহরিণ শব্দে মনে পড়ে এক বেরসিক স্কুল মাস্টারকে, যিনি দন্তন্যর ভুল প্রয়োগে আমাকে বেত্রাঘাত করেছিলেন বাঘের থাবার মতন।

 

 

দুর্গাবালা

দুর্গার দশটা হাতের সাথে দশটা কানও দরকার ছিল। দশটা হাতে যদি দশটা লেটেস্ট চোখফোন থাকে, তারজন্য দশটা কান প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক নয়। দশটা চোখ এবং দশটা মুখও থাকা চাই কেননা দশটা ফোনে কথা বলবার মুখ, ডিসপ্লে দেখবার জন্য চোখও অবশ্যই চাই। দুর্গার আর কী কী থাকা অত্যাবশ্যক ছিল সে সম্পর্কিত ভাবনায় ইস্তফা দিয়ে নতুন চাকরির দিকে ছুটছি।
দু হাত সমান তালে না চলবার কারণে চাকরিটা গেল’— আজকের শীর্ষ সংবাদ। অভুক্ত রাইখো না বেশিদিন মা; চাকরি পেলেই চরণে দিব গুড়ের প্রসাদ।

দেবী মা, তোমার কাছে আশ্রয় চাইছি বইলা দোহাতি বালা
একেলা রাইখা চইলা গেছে
সব ফিরায়া দেও, গুড়ের অফারটা বলবৎ আছে।

 

 

 

লী বালা

প্রেমের জন্য এতটা 'কে' কবে করেছিল শুনি
আমার ভাই 'কাবিল' প্রেমিক ও খুনি,
ওহে আকলিমা
ওহে হাবিলের জোড়
সাথের পুরুষকে মরতে দেখে কেমন লেগেছিল!

তোমার ঠোঁট আমার আদর্শলিপিপ্রথম পাঠ,
তোমার বুক আমার হৃদয়বিকাল মাঠ।
তুমি আমি পুরোটা মিলে মিহি তুচ্ছ ধুলো,
ঈশ্বরের কপাট খুলে ফেলে
প্রেম ও ঈর্ষা ছড়াচ্ছে আমাদের ছেলেমেয়েগুলো।

 

কাপ

আমাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল এক গুহার মতন ঘরে, ইলেকট্রনিক বাতির আদরে জানতাম না কখন দিন-রাত এসে চলে যায়।

নিশ্চয় দিন ও রাত খুঁজতে আসে আমাকে।
পুলিশ এবং সংবাদ সংস্থার মতো—,
মোড়ের ভিখিরি, দোকানদার আর আড্ডার দরকারে কয়েকজন এখনো বিশ্বাসে রাখে আমারে,
কোনো একদিন ইউরোপ কিংবা আফ্রিকা থেকে নাজিল হব,
নতুন জ্ঞান বিলাবো, নিত্যনতুন যুক্তি- আমাদের দেবে মুক্তি!

আমি এই বদ্ধ আলোকময় ঘরের নিঃসঙ্গতা চিরে বেরুবোই একদিন।

 

 

 

শিশু গাছ


একটা জমি ফসল চাষের বুকের মধ্যে পথ পেয়ে যায়
একটা জমি দুইটা হবার নব্য নেশায়
স্থিরতার চোখ কপালেআগুন ধরায়
আগুন আলোয় ভাত হয়ে যায়।

পরিণয়টা, দুপুর তাপে উগড়ে গিয়ে
এক বিকেলে ছিন্ন হলোকান্নামতন জল বেলারা
চোখ জানালার বাইরে এসেবাষ্প হয়ে মেঘ বনে যায়
বৃষ্টি ঝরায়, বুকের মধ্যে দুঃখ লাগে
হঠাৎ আসা দমকা হাওয়ায়, বিদায় কথায়
সব ভেঙে যায়! সব ভেঙে যায়?

ছাদ বাগানকে সঙ্গী করে প্রতিবেশির হাড়ি চুলো
জানালার পর্দাগুলোঅন্য বাড়ির সকাল হলো
বিদায় নয়নতুন আখ্যান
বীজগুলো ঠিক মাটির তলায় এমনি করে চলে গিয়ে
শুরু করে সবুজ চারার গতির গান।

বিদায় নয়নয় বিদায়, ঝরা পাতারা মাটিতে হোক সার
শিকড়েরা পুষ্টি পাক, ফল ধরুক পুষ্ট গাছে
নতুন শিশু বাঁচবে বলে গাছ জীবনহাত বাড়িয়ে আছে

 

 

 

কর্তৃত্বশীলা

দুইহাত পৃথিবীর দুইদিকে মেলে ধরে
বিশ্বাসী কণ্ঠ আর রক্ত মাখা শরীরে
যীশু কার গান গায়কাকে চায়!

তুমি কি তাকেও গেছো ছেড়ে; অনাথ রোদেরে
যেমন আদরে ঢেকে দেয় মাঝেমাঝে মেঘ আর
অশান্ত আবেগ ঝরঝর কাঁদেতোমার প্রেমের ফাঁদে
কত যুবক কিংবা যীশু পরেছে প্রেমের শেকল-মালা,
আশ্চর্য বালা,
কণ্ঠে জিকির দিলাফকির বানাইলা!


ফুলবালা

তারা হাঁটে- গান গায়।
পায়ে পায়ে প্রার্থনায়- সুরে সুরে- নাচের মতন চলে

তারা শান্তির কথা বলে, তারা বকুল ফুলের মতো
ঝরবার ক্ষত ভুলে আরো বেশি সুবাস ছড়াতে চায়,
তারা হাঁটে- গান গায়- ছেড়ে চলে যায়, নিষাদ ঝড়ে
কামড় দাগের মতন কী যেন গোপন গতরে- দেয় পীড়া
তারা হাঁটে- গায়- চলে যায়; তাদের হয় না আর ফেরা।

কিংবা ফেরা হয়, যখন থাকে না নতুন কিছুর লোভ
তখন পরাজয়, নত করে দেয় প্রাক্তন যৌবন দম্ভ।
তখনও কি মানুষ গায়- হাঁটে! নাকি স্থিরতার আরম্ভ
বকুল কোরে যারা চলে গিয়েছিল একদিন- হঠাৎ ঝড়ে,
পা আছে যে ফুলের- সুবাস গান তাঁর আশ্চর্য শরীরে!

 


বাক্‌ ।। ইহিতা এরিনের কবিতা


 

বিয়োগফুল

 

 

কহাকহির নামতা উড়ে গেলে সব ঠোঁট  বিয়োগচিহ্ন।

যেসব ড্রইংরুম এককে যৌথযেন তারা নিঃসঙ্গ কফিন পেয়ালা।

 

প্রপিতার ব্যক্তিগত হাসপাতাল

বিছানায়

সকল নামের বিয়োগচিহ্ন

যোগ হয়

প্রত্যেক নাম ফোটায় বিয়োগফুল।

 

সম্পর্ক,

বাগানের চিবুক থেকে খসে পড়ে লালের চিহ্ন।

মানুষ,

জন্ম থেকেই নিঃশেষ-বিভাজিত বিয়োগজীবী। 

 

 

 

 

গিটারিস্ট আঙুলের ইশারা

 

জলাশ্রিত মাংসাংশ ১তারা, কাছেপিঠে সীমান্ত ওপা তবু পড়া যাচ্ছে জলজ ঝুমঝুমি!

 

       এমন তরলায়িত রাতে দূরের ল্যামপোস্ট খুলছে নুনের স্বাদ, সমদ্বিবাহু ত্রিভূজ তখনও খোলে নি গ্নেয় লাভার বেডরুম!

 

গিটারিস্ট পঞ্চম আঙুলের ইশারায় ঘামেরা খুলছে ৬৪কলার এই মহাবিদ্যালয়!

 

লাভা ও লালার সুতোমিশ্রিত আমাজন বনজপত্রী একটা ম্যাচবক্স ও ড্রপআউট ক্যাচের অভাবে ভুখা রয়ে যাচ্ছে আজও...

 

 

 

 

নীরবের ঘুমঘুঙুর

 

রাত একথালা নেশাতুর নিশিবাদ্য

   বাজছে খলবলিয়ে কিন্তু শব্দ হচ্ছে না

 

নীরবতা; সব কান্নায় চোখের জল জরুরি নয়...

 

         অভিমানে ফেটে পড়ে আঙুরের ঘুমঘুঙুর নাতিদীর্ঘশ্বাস

 

দ্রবীভূত কুয়াশার ঘ্রাণ থেকে ঝরছে ওচানের জরায়ু

 

জলে কোন জল থাকেনা যেমন পায়ে থাকে না পা

 

এমন পাহীন রাতের দরজা খুলতেই চোখেরা সটান দাঁড়িয়ে যেন ওয়াচডগ 

 

 

 

 

 

 

১টি পার্থিব; কয়েকটি অপার্থিব অভিমুখী

 

-এর পাশে শব্দকে শুইয়ে দিলে

নৈঃশব্দ্য দাঁড়িয়ে 

                 অন্ধকারের

চিবুক ছুঁয়ে

সংখ্যার সাথে শব্দবন্ধ

জড়ো করলে ওড়ে ~ পোশাকি তারিখ

জীবনের সাথে তারিখ

সেলাই করলে

                        আলবৎ

সংখ্যা-মৃত্যু

 

আমরা জানি     (মৃত্যু) = (বিয়োগ)

 

মানুষ মূলত অমর; মৃত্যু তার জন্য ইস্যু নয়

করতলে বয়ে যায় মৃত্যুজ অগণন

 

কেননা

জীবিত মানুষের       মৃত্যু-অভিজ্ঞতা নেই

 

 

 

 

 

ঢেউ গোনার পর

 

নাচবা?

নাচ পা...

নাচো নীরবতা!

 

ঢেউবাজনের শর খোলো অথবা ফানাফিল্লাহ বাজাও নুনহাসি;

 

আমি সাঁই গাছ ___

দূরাহত জনসভায় বসে গুনছি সামুদ্রিক হাসির নাদ

 

শুঁড়িখানার জলজ ঢেউ 

                  কোথাও থাকে না কেউ,

 

যেখানে যেখানে পায়ের ছাপ রেখে এসেছো,

সেখানে ফের গেলে মাজার বানাবো;

নাম দেবো ফসিলমাজার

 

বাজাও নীরবতা! নীরবতা নাচো!

 

 

 

 

 

ত‌্যাগ-মঙ্গল

 

ঝিঁঝি। ব্যাঙ। বৃষ্টি।

থ্রিসাম সন্ধ্যা।

অথবা অ-সাম জৈব সারগাম ভরা মরশুমে

প্রমিত প্রেমের সঙ্গীত শোনায় অপরাপর।

 

শুনছি ক্ষুধার্তের ত্রাহী চিৎকার

এই যারা শীল নির্দেশক সমাজ

তাদের কান কি তরঙ্গ সঞ্চারি?

 

ওই উহারা

উন্নাসিক খিদের চিৎকারে সোল্লাসে মুতে দিলো

আহা যৌগ! তার যথার্থ রাসায়নিক সংকেত জানাও।

সারকথাও জানালো, নিদেনপক্ষে মরবে না পানিশূন্যতায়।

 

 

 

 

 

সংলাপিত দৃশ্যের পাটাতন

 

কেন্দ্র থেকে প্রান্ত সরেসরে 

       যাত্রা

                          অভিমুখ // ভাঙন

দূরে 

ফালি ফালি 

          অস্পষ্ট তরমুজ রঙ আভাআভা //

রক্তপাত

ধমনী ছিঁড়ে      নুনমিঠে

                             পেশি, তন্তু 

চুনসুরকির সাথে        স্বৈরাচারি সাঁতার //

 

পর্দার পেছন 

দাঁড়িয়ে একটা ফুল ফুটে ওঠার  গল্প

ধীর পায়ে অবসিত সন্ধ্যা। কবর খুঁড়িয়েরা

                                        সরে যেতে বলে

পাশ থেকে দেখি তার মুখ। কটাক্ষ অবিকল মুরকন্যা চোখ। কান ঝরায় অগণন তুষার ফুলকবর খুঁড়িয়েরা                           সরে যেতে বলে

 

দেখি

          তার স্থুল কলেবর চূর্ণবিচূর্ণ মুখ 

 

 

 

 

 

 

ডিভাইন কমেডি

 

মৃত মাছের চোখ আমি অথবা বেয়াত্রিচ

স্বাক্ষরের কাঁটাতার পেরোনোর চেয়ে সহজ খুব ফুসফুস বরাবর ঠাসা এ কে ফর্টি সেভেন।

 

দান্তে অথবা তোমাকেই ফরাসি চুম্বন

উড়িয়ে দিয়েছি ভোরের কুয়াশা বাক্সে।

 

আমাদের মাঝে সাইঁত্রিশ সংখ্যক ভীড়বাট্টা।

নিষিদ্ধ চুম্বনের ঠোঁটোগ্রাফে এলো

জেলখানা ফেরত খামহলো কুয়াশাই জয়ী কিংবা অনন্ত মিথ্যে।

 

ডিভাইন কমেডি হাসলো হা হা...!

 

 

 

 

 

সঙ্কোচন-প্রসারণ

 

সম্মুখে দাঁড়িয়ে গতকাল

 

খোসা ছাড়ানো পেঁয়াজের ভঙ্গি

উপমামূলক

অধস্তন সচিব ঝুঁকে আঁকেন ০

 

কাগজের মতো পোড়া ত্বক

খসে পড়ছে অনিয়ন্ত্রিত

বঞ্চিত মুখগুলো চালান

ওপার সীমান্ত

পচাগলা মাংসাশী পাখি

 

আয়না

প্রতিবিম্ব

চালুনি

 

আগামীকাল বিমূর্ততার বাধ্যমঞ্চ

কেন মানুষের অশ্রু হবে মোম

যখন কাঠের পৃথিবী ব্যর্থতায়? 

 

 

 

 

 

অন‌্য অগস্ত্যযাত্রা

 

দশমিক-ভর্তি শরীর উড়ছে হুকখোলা শূন্যের দিকে।

জ্যোৎস্না-গন্ধায় কোন ঐকিক নিয়ম থাকে না

শরীর বগিহীন ট্রেন -

ক্ষিতিজ রেখা বরাবর হুইসেল বাজিয়ে আগমনী সংকেত

জানিয়ে স্টেশনে ঢুকে পড়ছে আরও একটি বিদেহী ট্রেন।

বিষতুতো স্টেশনে নেমে পড়বো ব্রাকেটে বন্দী -

পরজীবী জীবনে তালা আর মরচে ধরা চাবিও মরীচিকা

বাউল শরীর নিয়ে ফিরবো উৎসে অবগুণ্ঠিত গুহামুখে।

 


বাক্‌ ।। মারুফা মিতার কবিতা

 


স্নায়বিক

 

 

ঠিক ঠিক মধ্যদুপুরে

পাখিদের কানকথা বাড়ে

অগোছালো ছায়ার মাঝে পড়ে থাকে কিছু আমিষাশী আচরণ। 

আমাদের জমে থাকা যত ব্যক্তিগত গুমোট 

তাকে রিপভ্যান ইউংকেলের ঘুম নামে ডেকো 

(সেইসব ঘুমের ভিতর কেউ কেউ

রেইনকারনেশনের গুপ্ত মন্ত্র নিয়ে মোন পাহাড়ে হারাবে একদিন)

 

আমাদের ফিরে যাওয়ার কোনো কথা ছিল না, তবু

পরস্পরের শরীর সেলাইমেশিনে মেলে দিয়ে,

ক্ষত শুকানোর আগে আমরা ফিরে যাব

যেখানে সন্ধ্যা হলেই, দিলবাহারের তারে

রাধিকা মোহন মৈত্রের আঙুল কাঁপে, ধীর লয়ে।

 

 

 

 

 

 

 

বিকল্প বৃত্তে

 

 

বাদামের খোসা ছড়ালে

আবারও স্বল্পব্যয়ী শনিবার আসে,

তোমার ঘুমের ভিতর পুস করে দেয় আর্টিফিশিয়াল স্বপ্ন 

স্বপ্নের ঘোরে কাতরাও, কেঁদে উঠ। 

মসলাপর্ব শেষ হওয়ার আগেই

ঘুম ভেঙে যায়, তখন

আংশিক তুমি অথবা তোমার মতো কেউ

প্রিয় কুকুর নিয়ে বিকেলের পার্কে হাঁটতে যাও। 

 

এসবই যেন ম্যাজিশিয়ানের হাতে রঙিন রুমাল 

মুহূর্তেই ভেল্কিবাজির পায়রা হয়ে উড়ে যায়।  

 

মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে

জোসনা কথাটা উচ্চারণ করলেই

তোমার আঙুল থেকে রুপালী সুতোয় ভর করে কিছু নর্ম নামে। 

 যেখানে বর্ষা এলে শুধু শুধু আমরা

"ভরা বাদর মাহ ভাদর" গাই, যেমন করে

ফুটানো চায়ের পাতা একটা সন্ধ্যাকে আরও মিডিওকর করে তোলে।

 

 

 

 

দীর্ঘসূত্র

 

 

কাউনের ক্ষেতে চুপকথারা ঘুমিয়ে গেলে

পৃথিবীর শরীর ভারি হয়ে উঠে। 

দুপুর ক্রমশ আলগা হয়ে যায়

আরও বেশি মনমরা নিয়ে শুকায় আনাজের ডালা,

আমরা বসে থাকি সাধারণ আলাপে। 

 

গৌড়নাচের এ বৃষ্টিবেলা 

লিরিক পড়ে থাকে শরীরি আবর্তে, তখনও

অশোকের ঘোড়া বনবীথির নাগালের বাহিরে,

খুরের শব্দে হারিয়ে যাচ্ছে

মাগধী ভাষার উপদেশনামা। 

 

আমরা বসে থাকি বিকালের ভিতরে

বিড়ালের আলস্য ফুরিয়ে যাওয়ার আগে,

একদিন উঠে যাব, যে পথে

ডাইনির আস্তানা থেকে পালিয়ে গেছে হ্যান্সল ও গ্রেটেল। 

 

 

 

 

 

অন্ধ পর্যায়কাল

 

 

ছড়িয়ে থাকা রাত্রির পায়ে মুমূর্ষু ইবাদত

আলোর বিপরীতে দাঁড়ালে

রিলিফ ক্যাম্পের ছায়া কেবলই দীর্ঘতর হয়। 

 

আলতো পি চাপড়ে ঘুম পাড়িয়ে যায় যে পাখিবেলা

সেখানে ঈষৎ ভাসে নামাবলী, যেন 

কেউ হলুদাভ নদীতে আয়ুকাল গুটিয়ে নেয়। 

দাওয়ায় বসে মেঘের পুজো দাও

বাড়ন্ত বুকের নির্যাসে পিতামহরা ডুমুর  গাছ হয়ে জন্মাবে। 

অথচ যতটুকু উলের প্রার্থনা ছিল

তার অধিক আহত ভেড়ার শুশ্রূষা নিয়ে যে বসে থাকল,

তাকে বৃষ্টির কাতরতায় নতমুখী সন্ধ্যা মনে হয়।

 

বৃষ্টি শেষে ধবল জোসনায়

ভুলে পাওয়া কাক ডেকে উঠে

কাছাকাছি কোথাও আরও দুই, তিনজন বারান্দা উড়ে যায়। 

 

 

 

 

 

বরষা

 

সবকিছু মুছে দেয়ার পরে

গেরস্ত চাঁদ হাঁপায় জলের কিনারায়। 

 

শূন্য দীঘি

পাড়ের ঘাস এবং অঘাসে

বিসুখ হওয়ার মতন

কাঠের খড়ম থেকে মেহগনি ঘ্রাণ লেগে গেছে। 

 

ঘাটের সিঁড়িতে অগোছালো 'সূর্যসিন্ধান্ত' পড়ে আছে। 

 

আরও নেমে গেলে

ঘন্টাখানিকের জন্য চমৎকার এক জলের ভাঁজ খুলে যায়,

তখন আর্যভট্ট সমস্ত মৌনতা উগরে দেয়। 

মনে হবে 

পৃথিবীর আকাশ থেকে পুলস্ত্য পশ্চিমে সরে যাচ্ছে,

ভরা বাদলের দিন সন্নিকটে। 

 

 

 

 

 

 

 

জলের সমস্ত চমৎকার নিয়ে পড়ে আছে অন্ধ পেয়ালা

 

 

বিরজু মহারাজার ঘুঙুরের শব্দ থেমে যাওয়ার আগেই

তুমি অন্যমনস্কে জানালার পাশে দাঁড়াও

ফ্রিজ খুলো, মনে হয়

এইমাত্র বারনই নদীতে গলা ভেজালে,

কন্ঠায় জমে থাকা বুদবুদ উসকে দেয় আহ্নিকগতি

তার পরের দিনেই কিনা

তোমার আঙুল থেকে গড়িয়ে পড়ে একটা আমিষাশী ভোর 

যেখানে বাতাসের ভিতর অনেক সুপারি ফুল ঝরে,

আর কিছু সাবুর পাঁপড়ের মত চিড়চিড়ে রোদ

সমস্ত রোদের ফোটন তুমি ইচ্ছা মত ব্যবহার করিও। 

 

এমন রোদ ঝলমলে নুরানি দিনে পীড়িত কলতলা, 

বালতিতে ভিজিয়ে রাখা বাসি কাপড়ের রঙ

ছড়িয়ে পড়ে সাবানজলে। 

তোমার কামিজ থেকে দুটো সেলাই খুলে রেখেছেন

দর্জির আঙুলে আরও দুই চোখ

গজিয়ে উঠছে ধীরে।

 

 

 

 

 

 

 

হেয়ারিং এইড

 

 

আগস্টের দুপুরগুলোকে এক বিষণ্ণ সাপ পেঁচিয়ে 

 

ওয়ার্ডরোবে ভাঁজ করে রাখা পুরোনো শরীর

বাথটাবের স্মৃতি নিয়ে জেগে আছে,

যদিও এই নদীমাতৃক শহর 

পাতচাউলি ঝাড়ে পাখিদের মতোই ন্যুডিটির ইন্ধন যোগায়। 

 

দূরবর্তী মরচে পড়া কার্গো ট্রেন ফিরে আসে

চোখের ভিতর লাল বিসুখ ছড়িয়ে যাওয়ার মত করে,

ফলত অপটিক নার্ভে যে চাপ পড়ে

সেখানে এক ছায়া ছায়া দেয়ালে হিংস্র ও নিরীহ ঝুলে থাকে পাশাপাশি 

দূর থেকে দেখলে মনে হবে ভাই-ভাই।

 

আমাদের বিকেল কেবলেই নিম্নমুখী পারদস্কেল 

সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে ঝরে পড়ে মৌন ফুটেজ,

দক্ষিণের  সাঁওতাল পাড়া পেরুলেই 

কামুকতায় শুয়ে থাকা পরিত্যক্ত ফেরিঘাট

তার কাছেই সাত বছরের নিরিবিলি কাল। 

 

ততদিনে আমরা জেনে গেছি

বাতিল হওয়া জুতো পায়ের দাগ বয়ে বেড়ায়। 

 

 

 

 

 

 

জোড়া শালিকের মিথ

 

 

বিহ্বলতার সন্ধ্যা এক অস্থিতিস্থাপক বিন্দুতে মূর্ত হয়ে ওঠলে

আলোছায়ার পৃথিবী নুয়ে পড়ে

হলুদ কণার ভিতর যে সহজ পারাপার, তার নিকট

প্রাচীন দাইমা বসে থাকেন।

 

 

ঝিনুকের খোল থেকে ঝড়ে পড়া চুন জামায় লেগে যায়

আর কতটা পথ পিছনে গেলে

খাজুরাহোর দেয়ালের শীত আঙুলে উঠে আসবে?

এই অমীমাংসিত সুর খানিকটা সাংসারিক  যদিও বা,

ঘন হাওয়া দিলে

ধান ফোটার শব্দ হয় ধীরে

সিদ্ধ ধানের ঘ্রাণে গার্হস্থ্য চরিত্ররাও পালটে যায়। 

ভূর্জপত্রে রচিত হয় শিশুর চোখে ঘুমের উল্লাস

গ্রামীণ মেয়েরা পৌরানিক আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসে

গুল্ম জীবন বিনিময় করে পরস্পর,

প্রত্যেকের মুখের উপর প্রসূতি হাঁসের ছায়ারা খলবল করে নিয়ত।

 

সিলিকার দ্বিধাগ্রস্থতায় মুখগুঁজে নদী পড়ে আছে

অতিদূর তরমুজ ক্ষেতে

চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করে লাল অসুখ।

 

 

 

 

 

 

ঊন বাড়ি, তোমার গায়ে অযুত রাংচিতি

 

হাসপাতালেরও আছে কিছু ব্যক্তিগত অসুখ

এই ভেবে ক্রিসমাসের ছুটিগুলো আগলে রাখে খুব

যেন বা, সব কিছুই হাতের আঙুলে সহজ সংখ্যাতত্ত্ব।

যখন জানালায় পূবের বাতাস

পিটিআই রোডে হেটে যাই মেহগনি পাতার উপশহরে,

জুটমিলের ঘরঘর আওয়াজ

ধাক্কা দেয় ঊন বাড়ির খিলখিল দুয়ারে।

 

নিজস্ব বুননে আরও কিছু বাতাস

রূপচর্চার মিহি থিউরেম

দুপুর অবধি শান্ত বাড়ির জানালা,

মূলত, সমুদ্র বিষয়ক কর্মশালা আত্মস্থ করে।

আরও বেশি গভীরতায় লবস্টারের লাল ধারণা নিয়ে

হাত বোলালেই বুঝতে পারি

ঊন বাড়ি, তোমার গায়ে অযুত রাংচিতি।

 

 

 

 

 

 

ক্লাউনের আস্তিনে গোটানো নগরের যত মিথ

 

 

উড়ে যাওয়ার ভিতর কোন মর্মর নেই, তেমন নিঃশব্দে

 

সপ্তম দুপুরে সার্কাস ভেঙে গেল। তাবুর তলে অজস্র বেনামী বেলুন ছড়ানো ছিটানো। পড়ে আছে টিকিটের ইতঃস্তত বেলা। ছেঁড়া ত্রিপলের ফুঁটো দিয়ে ঝাঁক ঝাঁক রোদ ঢুকে পড়ছে।

ক্লাউনের মুখ থেকে সব রঙ মুছার আগেই, আমরা আনাজের সাথে ভাত মাখাতে মাখাতে দুপুরের ঘুমে ঢুকে গেছি। ঘুমের ভিতর এক চৌকস স্নাইপারের লক্ষ্যবস্তু হয়ে বসবাস করছি, দৌড়াচ্ছি।

 

 

 

 

 

 

 

দূরবর্তীর

 

বুড়াইল নদীর পাড়ে একজন অর্ধেক ভিক্ষুকের ঘোড়া বৃষ্টিতে ভিজছিল। ভেজা ঘাসের কাছাকাছি মন নামিয়ে। আকাশ তখন দুপুরের বিষয়বস্তু। আর দূরবর্তী স্কুলের কামরাগুলো টিফিন বক্সের ভিতর নিরিবিলি।

এই রকম একটা দৃশ্য নিয়ে হারিয়ে গেছে আমার নিজেস্ব দূরবীন। 

 

 

 

 

দাগ

 

 

শ্যালোমেশিন থেকে উঠে আসা ঘড়ঘড় আওয়াজে

কান পাতি কিছুটা কান্নার মতন করে,

এই সহজ স্বীকারোক্তিতে জমা হয়ে আছে

ভোরের চোখে মেরুনরঙ মাফলার।

 

বাসন্তিক ধানের নামে

বাপ-দাদার আবাদি জমিতে পুঁতে রাখা বীজকথা

আইলের পর আইল আগুর ফলনের মন্ত্র।

চাষে মনযোগী আমি নামতে থাকি ধারাপাতে

টের পাইঘোলা জলের শব্দে মাগুরের ঘাই

লাঙলের ফলায় জন্মদাগ লেগে আছে, শুকানোর আগে

অহংকারী সুড়ঙ্গ পথ পৌঁছাবে মৃত্যুফুল বরাবর।

 

 

 

 

 

 

 

ঊনব্যাঙ

 

 

শুকিয়ে যাওয়া কুয়োর নিচে

খানিক জলে, খানিক অতলে

সম্মোহিত হাফমুনের আচরণ, 

সন্ধ্যার গায়ে আলো জ্বালালে কেউ 

চামড়ায় ফোটোটক্সিসিটি বাড়ে,

বুড়ো ব্যাঙ হাঁপায় আরও বেশি। 

 

বিনাই খালে জাগ দেয়া পাটের গন্ধে

স্মৃতিবেলায় পুরোনো দিনের লাফগুলো,

রাবারের অসুখ ছিটিয়ে

আঁশটে পোশাকে বর্ষা পেরিয়ে যায়।  

 

 

 

 

লুপ্ত হরফের মাঠ

 

বাতিল ট্রেনের বগি ভর্তি কুকন

এখনও তুঁত পাতার সবুজ ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে। 

 

বিকেলের নিকট বুড়িমা ছড়িয়ে থাকেন

আঁচলের গিঁট খুলে গেলে,

আতপচালের ঘ্রাণ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন একজন না-বোধক বিড়াল। 

তখনও তোমার হাতে লেগে থাকা ভ্যানিশিং ক্রিমের ঘ্রাণ

পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় এক নির্মোহ যতিচিহ্নে।

 

এইসবই নাটায়ের ছিঁড়ে যাওয়া সুতো

উড়ে যায় কাঁচগুড়োর মাঞ্জার ধারণায়। 

 

চিনিপাতা ফুল ছড়িয়ে পড়ার আগে সন্ধ্যা নামে নির্ভার রেলব্রিজে,

বাতাসের খচখচানি জিগা বন পেরুয়

শহরের শেষ বাড়ির জানালা দুলে উঠলে

দেখ, মেরুন টেবিলক্লথে

সেলাইয়ের ফোঁড় ভাইকিং ওরিওরের নির্ঘুমতা এঁকে দিচ্ছে। 

 

 

 

 

 

 

নিদান

 

 

আচারের বৈয়ামে রাজবংশী তরুণীর সুরম্য আঙ্গুল ঢুকে যায়

নখাগ্রে শ্বাসমূল জাগবে একদিন। 

 

ক্রমশ হালকা হয়ে যাওয়া বিনাই খাল

কালো জলে বড়নখা ফুলের মুখ ভিজে যায়।

ছায়া ছায়া কাঁপনে পড়ে থাকা যত

পাখি উড়ার ফুটেজ, 

সুস্বাদুর অঙ্গীকারে মুছে ফেলেছিল তারা 

যেমন করেবর্ষার সমস্ত জবাফুলের শরীর লাল হারিয়েছিল৷ 

 

অতটা বিপদগামী নয় কারুর পা

 

তবু কমফোর্ট জোনে দাঁড়িয়ে 

মফঃস্বলি স্টেশনের বৃত্তান্ত ক্রপ করছে কেউ,

অথচ একটু হেলে

রাস্তাটা তার দেশের বাড়ি হেঁটে যায়।